কালের বিবর্তনে ভূষণছড়া গণহত্যার বিষাদময় প্রহর এখনো পার্বত্যবাসীকে শিহরীত করে তুলে।

৯২
আলোকিত লংগদু ডেক্সঃ
সবুজের চাদঁরে ঢাকা সুপ্র মেঘের পরশ ছোঁয়ানো এক স্বপ্নীল ও রুপময় ভূ-খন্ড পার্বত্য চট্টগ্রাম । অপার সম্ভাবনার এই ভূ-স্বর্গর্টি শান্তিচুক্তি সম্পাদনের আগে ছিল অশান্ত দূর্গম প্রতিকুল জনপদ। তার মাঝে নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা। যেখানে ৩১ মে ১৯৮৪ (শান্তিচুক্তির পূর্বে) সালে সংগঠিত হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বৃহৎ এবং ভয়াবহ হৃদয় বিদায়ক অমানবিক হত্যাকাণ্ড। সে বিষাদময় গণহত্যার করুন কাহিনী আমাদেরকে আজো শিহরীত করে তুলে । বিষাদময় এ গণহত্যাটি ঘটে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় বরকল উপজেলার অন্তর্গত ভূষণছড়া পাহাড়ী অঞ্চলে। এটি একটি পাহাড়ের আলোচিত স্থান। উপজাতি ও বাঙ্গালি সম্প্রদায়ের যৌথ বসবাস করা একটি ইউনিয়ন। অত্র ইউনিয়নের কলা বন্যা, গোরস্থান, ভূষণছড়া, হরিণা হয়ে ঠেকামুখ সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত এই বিশাল পাহাড়ী ও নদী ঘেরা জনপদটি। ভূষণছড়া রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা থেকে প্রায় ৫৫.৫ কি,মি পূর্ব ও উত্তরে রাঙ্গামাটি লেক (কর্ণফুলী) নদীর তীরে এবং ভারতীয় সিমান্তের নিকটে অবস্থিত। তিনদিকে পাহাড় ঘেরা ভূষণছড়া এলাকাটি। পাহাড়ের অদূরেই বসবাস ছিল (জেএসএস) -এর সশস্ত্র সংগঠন শান্তিবাহিনী সন্ত্রাসীদের। ১৯৭১ সালের পর থেকে পাহাড়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) -এর সশস্ত্র সংগঠন শান্তিবাহিনীর হাতে অসংখ্যবার পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিরা গণহত্যার শিকার হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম সবচেয়ে বৃহৎ এবং ভয়াবহ হৃদয় বিদায়ক অমানবিক হত্যাকাণ্ড এটি।
শান্তিবাহিনীর হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে রাজনগর গণহত্যা, পাকুয়াখালী ট্রাজেডি, মাটিরাঙ্গা গণহত্যা, দীঘিনালা, কাউখালী, রাজস্থলী, ভাইবোনছড়া, পানছড়ি, ভূষণছড়া গণহত্যা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আর পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েক শত বছরের ইতিহাস ঘাটলেও ভূষণছড়া গণহত্যার মতো এত বড় ধ্বংসযজ্ঞের আর কোন নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনকি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানী পাষণ্ডরাও বাংলাদেশে এমন জঘন্যতম ঘটনার জন্ম দেয়নি। ১৯৮৪ সালের ৩০ মে দিবাগত রাত আনুমানিক ৪টা থেকে পরদিন সকাল ৮টা ৩০মিনিট পর্যন্ত সময়ে অর্থাৎ ৩১ মে সংঘটিত পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায় ভূষণছড়া গণহত্যা। সেই
রাতে ঘুমন্ত সাধারণ জনতার উপর হিংস্র হায়নার মতো ঝাপিয়ে পড়ে এ সন্ত্রাসীরা। সন্তুলারমার নির্দেশে এ হত্যা কান্ড পরিচালিত করে মেজর মনিস্বপন দেওয়ানের নেতৃত্বে একদল বিপগামী পাহাড়ী সন্ত্রাসী যুবকরা। বিরাট পাহাড়ী এলাকা জুড়ে সন্ধ্যা থেকে আপতিত হয় ভয়াল নিস্তদ্ধতা। যখন মানুষ, পশু পাখিরও সাড়া শব্দ নেই। আর্মি, বিডিআর, ভিডিপি সদস্যরাও ক্যাম্পে বন্দি।মুষ্টিমেয় সামান্য কিছু নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য সেখানে অবরোদ্ধ। অতর্কিত পূর্ব দিক থেকে গুলির শব্দ। তৎপরই এক শুরু হয় বিষাদময় গণহত্যার অধ্যায়। চুতর্দিকে ঘর-বাড়ীতে আগুনের লেলিহান হয়ে উঠতে লাগল। উত্থিত হতে লাগল আহত নিহত অনেক লোকের করুণ আর্তনাদ ও চিৎকার এবং তৎসঙ্গে গুলির আওয়াজ , জ্বলন্ত গৃহের বাঁশ ফোটার শব্দ, আর আক্রমণকারীদের উল্লাসের মূখর হ্রেসা ধ্বনি। চিৎকার, আহাজারী ও মাতমের ভিতর রাতের সমাপ্ত ও সুর্যোদয়ে জেগে উঠলো পর্য্যুদস্তজনপদ। হতভাগা জীবিতরা আর্তনাদে ভরিয়ে তুললো গোটা পরিবেশ। অসংখ্য আহত ঘরে ও বাহিরে লাশে লাশে ভরে আছে পোড়া ভিটা। এতো লাশ, এতো রক্ত আর এতো ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ এক অর্ধরাতের ভিতর এলাকাটি বিরান, অদৃষ্ট পূর্ব নৃশংসতা, অস্বাভাবিত নিষ্ঠুরতা। ছোট নিঃপাপ বাচ্ছাদের কান্না, স্বামীহারা নারীর আহাযারি, সন্তানহারা বাবা মার বুকফাটা চিৎকার আর আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠে আকাশ। লাশের উপর লাশ, মায়ের কোলে শিশুর লাশ,স্বামীকে বাঁচাতে স্ত্রী জড়িয়ে ধরেছিল। বাবা মেয়েকে বাঁচাতে জড়িয়ে ধরেছিল। মুহূর্তেই সবাই লাশ হয়ে যায়, শান্তিবাহিনীর পাশবিক আক্রমণে সেদিন।এ গণহত্যায় নিহতদের প্রকৃত সংখ্যার সঠিক তথ্য আজো পাওয়া যায়নি। নিখোঁজদের সংখ্যা এবং তাদের পরবর্তী অবস্থা জানা যায়নি। তা ছাড়া ঘটনার ভয়াবহতায় যে সব বাঙ্গালী পার্বত্য এলাকা থেকে পালিয়ে গেছে, তাদের কি পরিমাণ আত্মীয় স্বজন নিহত হয়েছে তারও সঠিক হিসাব পাওয়া সম্ভব হয়নি। যারা তথ্য দিয়েছেন তাদের তথ্য মতে মাত্র কয়েক ঘন্টা সময়ে হত্যা করা হয়েছে চার শতাধিক নিরস্ত্র নিরীহ মানুষ । এবং আহত করা হয়েছে আরও সহস্রাধিক মানুষ। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে একটি জনপদ। ১৬০০ পরিবারের মধ্যে তিন শতাধিক পরিবার সেদিন আক্রান্ত হয়েছে। আর আক্রান্তদের মধ্যে ১০০টি পরিবার সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। দীর্ঘ সময় অনুসন্ধান শেষে নিহতদের নাম ঠিকানা সম্বলিত যে তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে তাতে ৩৭০ জনের পরিচিতি পাওয়া গেছে। আর অনেকে আগুনের লেলিহায় ছাইঁ হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ভূষণছড়া গণহত্যা সহ অসংখ্য বর্বরোচিত ঘটনার শিকার হয়েছে পার্বত্য অঞ্চলে বাঙ্গালী জনগন। কিন্তু বাঙ্গালীদের উপর সন্ত্রাসী কর্তৃক সংঘটিত এসব নির্যাতনের চিত্র আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমতো দূরের কথা দেশীয় প্রচার মাধ্যমেও স্থান পায়নি। সে সময়ে দেশে সামরিক শাসন ও সংবাদ প্রচারের উপর সেন্সরর ব্যবস্থা আরোপিত থাকায় এবং পাহাড়ের অভ্যন্তরে যাতায়াত ও অবস্থান নিরাপদ না হওয়ায় অধিকাংশ গণহত্যা ও নিপীড়ন খবর হয়ে পত্র পত্রিকায় স্থান পায়নি। আর এই সুযোগে নির্যাতনকারী উপজাতীয়রা নিজেদের নৃশংসতার স্বরূপকে ঢেকে তিলকে তাল করে নিজেদের পক্ষে প্রচার চালিয়েছে বিশ্বব্যাপী। এতে দেশব্যাপী ধারণা জন্মেছে যে, পার্বত্যাঞ্চলের উপজাতীয়রাই নির্যাতনের শিকার। যার ফলে দেশ এবং সরকারের ভাবমূর্তি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি আন্তর্জাতিকভাবে সুনাম অর্জনকারী নিরাপত্তাবাহিনীর দায়িত্ব পালনেও প্রশ্ন উঠেছে।
May be an image of outdoors
কিন্ত কিছুই করার ছিলনা। সবাই অসহায় আর অবরোদ্ধ। সামন্য নিরাপত্তা কর্মীরা তাদের কাছে গ্লাসের পানির মতো। চুমুকেই নিঃশেষ সম্ভবনায়। ১৯৯৭ সালে তথাকথিত পার্বত্যচুক্তি করে জেএসএস তথা শান্তিবাহিনীর সদস্যদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলেও আজও পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি আসেনি। বন্ধ হয়নি হত্যাকাণ্ডও। কাগজে-কলমে শান্তিবাহিনী না থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র সংগঠনগুলোর দৌড়াত্ম্য কমেনি আজো, বরং তাদের হাতে বাঙালিরা যেমন হত্যার শিকার হচ্ছে, তেমনি নিহত হচ্ছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীগুলোর সাধারণ মানুষজনও। এহেন অবস্থায় এতো ভয়াবহ হত্যা কান্ডের বিচার করা না হলে, অদূর ভবিষৎতে আরো ভয়াবহ গণহত্যার সাহস করবে সন্ত্রাসীরা। আর মেজর মনি স্বপনদের বিচারের কাঠ গড়ায় দাঁড় করিয়ে, উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ উপস্থাপনের মাধ্যমে ভূষণছড়া গণহত্যাসহ পার্বত্য অঞ্চলের সকল হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের প্রকৃত বিচারের মাধ্যমেই পার্বত্য অঞ্চলের সঠিক চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা সম্ভব। এই নৃশংসতা বিনা বিচারে পার পেয়ে গেলে, এটা ভবিষৎ প্রজম্মকে আরেকটি নিন্দনীয় ইতিহাস জানতে এবং রাষ্ট্রের প্রতি প্রশ্ন তুলতে বিবেকে সাড়া দেবেনা।এ ক্ষেত্রে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে জাতিসংঘের নিজস্ব বিচার ব্যবস্থাও। আমাদের দেশেও ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা বিরোধীদের মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডের বিচার চলছে। তা হলে, স্বাধীন দেশে পার্বত্য অঞ্চলে যারা হাজার হাজার মানুষ হত্যা করেছে তাদের কেন বিচার হবে না? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে সাধারণ জনগন। এদেরকে প্রশ্রয় দেয়ার কোন সুযোগ নেই, একের পর এক গণহত্যার বন্ধ করতে এদের বিচার ও মৃত্যুদন্ড দেয়া অপরিহার্য্য হয়ে পড়েছে। এদের বিচার করে দেশকে কলংস্কমুক্ত করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট আকুল আবেদন জানাচ্ছি।

মন্তব্য বন্ধ আছে তবে ট্র্যাকব্যাক ও পিংব্যাক চালু রয়েছে।