৯০ বছরের বাজার ফান্ড ঋণ বন্ধ; ৪০ হাজার ব্যবসায়ীর মাথায় হাত
||আবু বক্কর ছিদ্দিক (পার্বত্য চট্টগ্রাম)||
চট্টগ্রাম পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রাণ ‘বাজার ফান্ড’র হাত ধরে বন্ধকী ঋণ কার্যক্রম বন্ধ করেছে তিন জেলার প্রশাসন ।
কোন ধরনের সরকারি নিষেধ না থাকলেও আমলাতান্ত্রিক প্যাঁচে ৫ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে এ ঋণ কার্যক্রম।
শত বছর ধরে চালু থাকা এ ঋণ না পেয়ে ব্যবসা বাণিজ্য লাটে উঠেছে প্রায় ৪০ হাজার ব্যবসায়ীর।
পার্বত্য তিন জেলার ১২৪টি বাজারে উল্লিখিত ব্যবসায়ীরা এ ঋণ কার্যক্রমের অংশ ছিলেন। বাজার ফান্ড সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, বাজার ফান্ড আপাত দৃষ্টিতে ফান্ড বা তহবিল মনে হলেও বাস্তবে এটি প্রতিষ্ঠান।
১৯৩৭ সালের বাজার ফান্ড ম্যানুয়েল অনুযায়ী পরিচালিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনীতির ভীত মজবুত করতে নতুন বাজার ও ব্যবসায়ী সৃষ্টি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে এ ফান্ডের জন্য। এ ফান্ডের হাত ধরে ব্যবসায়ীরা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তাদের ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করেন।
১৯৮৯ সালে পার্বত্য তিন জেলায় স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চালুর আগ পর্যন্ত এ বাজার ফান্ডের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকগণ। এরপর আইন অনুযায়ী বাজার ফান্ডটি ( প্রতিষ্ঠান ) পার্বত্য জেলা পরিষদের উপর ন্যস্ত হওয়ায় পরিষদের চেয়ারম্যান এ ফান্ডের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পান।
এরপর থেকেই তিন জেলার বাজার ব্যবস্থাপনা জেলা পরিষদের তদারকিতেই চলে আসছিল।
২০১৯ সালের ১৪ অক্টোবর খাগড়াছড়ির তৎকালীন জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে লেখা এক চিঠিতে বন্ধ হয়ে বাজার ফান্ডের ঋণ কার্যক্রম।
তথ্যমতে, বিষয়টি নিয়ে ২০২১ সালের ৮ সেপ্টম্বর পার্বত্য বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের তৎকালীণ মন্ত্রী বীর বাহদুর উসেচিংয়ের সভাপতিত্বে, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, তিন জেলার প্রশাসকের সমন্বয়েও বৈঠক হলেও এখনো কোন সমাধান আসেনি। এ অবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বাজার অর্থনীতি কঠিন সময় পার করছে।
এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংক পিএলসির পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. সাইফুর রহমান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার বাজার ফান্ডের আওতাধীন যে সমস্ত প্লটধারী ( বাজারের ভেতরে ) রয়েছেন তাদের বন্ধকী প্লট জেলা প্রশাসক কর্তৃক রেজিষ্টেশন না করায় এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে আমরা কোন বিনিয়োগ করতে পারছিনা।
এতে পার্বত্য তিন জেলার ব্যবসায়ীরা বিপদে পড়েছেন। এখানে মূল কথা হলো, বাজার ফান্ডের আওতায় ব্যবসায়ীরা নিজেদের নামে বরাদ্দ হওয়া প্লট বন্ধক দেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে। ব্যাংক তাদেরকে ঋণের ব্যবস্থা করবে। কিন্তু বর্তমানে পুরো প্রক্রিয়াটাই বন্ধ।
খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের নির্বাহী অফিসার ও বাজার ফান্ডের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা টিটন খীসা বলেন, বাজার ফান্ডের আওতাধীন ব্যবসায়ীদের মাঝে বরাদ্দ দেয়া প্লটে দীর্ঘ বছর ধরে ব্যাংকের কাছে বন্ধক দিয়ে ঋণ নিতেন।
২০১৯ সাল থেকে খাড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মহোদয় পার্বত্য বিষয়ক মন্ত্রনালয়ে এবিষয়ে মতামত চাওয়ায় বিষয়টি আটকে আছে।
টিটন খীসা আরো বলেন, বাজার ফান্ডের প্লটের বন্ধক বন্ধ থাকায় খাগড়াছড়ি জেলার ৩৬টি বাজারের ১৫ থেকে ২০ হাজার ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। সেই হিসেবে তিন জেলায় প্রায় ১২৪ বাজারে ৪০ হাজার ব্যবসায়ী ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন।
একই বিষয়ে বান্দরবান জেলা পরিষদের নির্বাহী অফিসার ও বাজার ফান্ডের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো.আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, বাজার ফান্ড নিয়ে জেলা প্রশাসকের সায় না পাওয়ায় ঋণ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ইসলামি ব্যাংক পিএলসি বান্দরবান শাখার ব্যবস্থাপক মো. সাইফুদ্দিন বলেন, বাজার ফান্ড নিয়ে কিছু মৌলিক ঝামেলা থাকায় আমরা ব্যবসায়ীদের মাঝে বিনিয়োগ করতে পারছিনা।
তিনি আরো বলেন, বান্দরবান সদরের ব্যবসায়ীদেরই প্রায় ২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ দেয়া যেত। এতে ব্যবসায়িরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। রাঙামাটি জেলা পরিষদের নির্বাহী অফিসার ও বাজার ফান্ডের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নুর উদ্দিন মুহাম্মদ শিবলী নোমান একই জঠিলতায় ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে লোন পাচ্ছেন না বলে জানান।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো.সহিদুজ্জামান বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমিও পার্বত্য বিষয়ক মন্ত্রনালয় মতামত চেয়েছি, আমার আগের জেলা প্রশাসকও মতামত চেয়েছেন এখনো কোন মতামত পাওয়া যায়নি। তাই বাজার ফান্ডের প্লট বন্ধক বন্ধ রয়েছে।
প্লট বাজার ফান্ডের, আমরা মর্টগেজ রেজিষ্ট্রি করে থাকি। যেহেতু অল্প সময়ের জন্য বাজার ফান্ড ব্যবসায়ীদের প্লট বন্দোবস্ত দেন।
কোন কারণে ব্যবসায়ীরা ঋণ খেলাপি হলে তার দায় নেবে কে‘। তথ্যমতে, বাজার ফান্ডের অনুবলে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয় ১০ বছরের জন্য। এদিকে বিষয়টিকে ব্যবসায়ীরা ‘আমলাতান্ত্রিক প্যাঁচ’ হিসেবে উল্লেখ করে এ বিষয়ে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। তা না হলে সহসাই পাহাড়ে অভাব অনটন দেখা দেওয়ার সম্ভাবনার কথাও জানান তারা।
এ বিষয়ে রাঙামাটি চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ জানান, আমাদের এখানে বড় কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান নেই। তার উপর প্রায় ৪শ‘কোটি টাকার কাঠের ব্যবসাও বন্ধ রয়েছে। মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো একটি মীমাংসিত বিষয়ে অযথা বিতর্ক তুলে ব্যবসায়ীদের মাথায় আঘাত করা হয়েছে। তিনি বলেন, ঋণ প্রক্রিয়া আটকে থাকলেও প্রশাসন লিখিতভাবে কোনো ব্যাংক বা ব্যবসায়ীকে এ বিষয়ে কিছুই অবিহত করেনি। যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৯ সালের ১৪ অক্টোবর তৎকালীন খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস বাজার ফান্ড এলাকায় বন্দোবস্তি দেওয়া জমিকে খাস জমি উল্লেখ করে ওইসব জমির বিপরীতে ঋণ প্রদানের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। তিনি এ বিষয়ে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা চেয়ে পত্র প্রেরণ করেন।
এরই প্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ২০১৯ সালের ৬ নভেম্বর তিন পার্বত্য জেলার বাজার ফান্ড প্রশাসকদের ( জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ) মতামত চাওয়া হয়।
এ অবস্থায় রাঙামাটি জেলা পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান ও বাজার ফান্ড প্রশাসক বৃষকেতু চাকমা দ্রুততার সাথে বিষয়টিকে জনগুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে ইতিবাচক মতামত দেন। একইভাবে তৎকালীন খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরি চৌধুরী ও বান্দরবান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা ও ইতিবাচক মতামত দেন। এরপরও বন্ধ রয়েছে এ ফান্ডের ঋণ কার্যক্রম।
রাঙামাটি জেলা পরিষদের সেই সময়ের চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমা দ্রুততার সাথে বিষয়টিকে জনগুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বাজার ফান্ড এলাকার খাস জায়গা ফান্ড ম্যানুয়েল অনুযায়ী ১০ বছরের জন্য লীজ প্রদানের বিধান রয়েছে।
খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান তথা বাজার ফান্ডের তৎকালীন প্রশাসক কংজরি চৌধুরী জানান, খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ আইন ১৯৮৯ এবং বাজার ফান্ড বিধিমালা ১৯৩৭ অনুসরণে অনুমোদিত হাট-বাজারে প্লটের বিপরীতে ঋণ প্রদানে কোনো বাধা নেই। এমন বাধ্যকতা আরোপ করা হলে এলাকার জনস্বার্থ বিঘ্নিত হবে বলেও মন্তব্য করেছেন কংজরি।