২৭ বছর পেরিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি: এখনো অশান্ত পাহাড়!

0 ২৬৭

২৭ বছর পেরিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি: এখনো অশান্ত পাহাড়!

মিলগার্ট জাওহারিঃ

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের ২৭ বছর পার হলেও চুক্তির বাস্তবায়ন এবং এর প্রভাব নিয়ে বিতর্ক ও অস্থিরতা রয়ে গেছে। ১৯৯৭ সালে যে আশা নিয়ে চুক্তিটি করা হয়েছিল, তা এখনো অনেকাংশে অপূর্ণ। সমস্যার মূলে রয়েছে চুক্তির অসামঞ্জস্যপূর্ণ বাস্তবায়ন, সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ধারা, এবং পাহাড়ি ও বাঙালি জনগণের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ।

পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা: ইতিহাস ও পটভূমি

পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা দীর্ঘদিনের। ব্রিটিশ শাসনকালে অঞ্চলটি “শাসন বহির্ভূত এলাকা” হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর এটি পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে পাহাড়ি ও বাঙালি জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক অধিকার নিয়ে বিরোধ শুরু হয়।
১৯৭২ সালে এম.এন. লারমার নেতৃত্বে গঠিত জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) প্রথম থেকেই স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানায়। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭৩ সালে “শান্তিবাহিনী” গঠন করা হয়, যা সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এই সংঘাত দীর্ঘ সময় ধরে সহিংসতা, প্রাণহানি, এবং উন্নয়ন কার্যক্রমের স্থবিরতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

পার্বত্য চুক্তি: প্রেক্ষাপট ও স্বাক্ষর

১৯৮৫ সাল থেকেই বাংলাদেশ সরকার সৃষ্ট সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য উদ্যোগ নেয়। দীর্ঘ আলোচনার পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির লক্ষ্য ছিল পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও পাহাড়ি জনগণের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষা। তবে চুক্তির বেশ কয়েকটি ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় এটি বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
চুক্তির আওতায় এমন কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল যার মূলে ছিল এটি বিশেষ গোষ্ঠীর গভীর দূরভিসন্ধি, যেমন:

আঞ্চলিক পরিষদ গঠন: পাহাড়ি জনগণের জন্য স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে করা হয়। যা অনেকাংশে চালাকি করার মতো।

ভূমি অধিকার নিশ্চিতকরণ: ভূমি বিরোধ মীমাংসার মাধ্যমে পাহাড়িদের ভূমি অধিকার রক্ষা। কিন্তু তার অন্তরালে ছিল জুম্মল্যান্ড বাস্তবায়নের নীল নকশা। দেশ ভাগের আরেকটি গভীর ষড়যন্ত্রের রোড় ম্যাপ ছিল এটি। যেটি বাস্তবায়নের নীল নকশা বিদেশী শক্তির উপর নির্ভর করে প্লান করেছিল সন্তু লারমা গাং।

কোটা প্রথা: সরকারি চাকরি ও শিক্ষায় পাহাড়িদের জন্য কোটা সংরক্ষণ। এটি একটি সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা যার সুবিধা শুধু চাকমা ও ত্রিপুরাই ভোগ করছে। যার মাধ্যমে অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছে চাকমারা আর পিছিয়ে পড়েছে অন্যান্য সকল সম্প্রদায়, বেড়েছে বৈষম্য।

সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার: অনিরাপদ এলাকাগুলো থেকে সামরিক বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পগুলো তুলে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত। যার ফলে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি ও গুম হত্যার সম্রাজ্য গড়ে তোলে উপজাতি সংগঠনগুলো। অবৈধ অস্ত্র ক্রয়ের প্রক্রিয়া হলো চাঁদাবাজির অর্থ। যা করতে তারা সক্ষম হয়েছে।

চুক্তি বাস্তবায়ন: ত্রুটি ও বৈষম্য

চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যে ত্রুটিগুলো সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে সেগুলো হলো :

চাকমা জনগোষ্ঠীর প্রাধান্য: চুক্তিটি মূলত চাকমা জনগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করেছে। অন্য পাহাড়ি জনগোষ্ঠী এবং বাঙালি সম্প্রদায় এর সুফল থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এটি এখন সবার মাঝে ক্ষোভ হয়ে দেখা দিয়েছে। যার ফলে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে আরো অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে।

ভূমি অধিকার সংকট: ভূমি মালিকানা সংক্রান্ত সমস্যাগুলো মীমাংসা হয়নি। বরং অনেক বাঙালি তাদের জমি হারানোর আশঙ্কায় রয়েছেন। সাংবিধানিক আইনের লঙ্ঘন হয়েছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে একই সাথে অনেক বৈষম্মের শিকার হয়েছে বাঙালি সম্প্রদায়।

সশস্ত্র সংঘাত অব্যাহত: শান্তিবাহিনী চুক্তির পরেও অস্ত্র ত্যাগ করেনি। বরং নতুন নতুন সশস্ত্র সংগঠনের উত্থান হয়েছে। পুরাতন অস্ত্র জমা দিয়ে আধুনিক নতুন অস্ত্রের ব্যবস্থা করেছে তারা। আরো বেশি অরাজকতা, প্রতিহিংসা, জুলুম আর অত্যাচার সীমা অতিক্রম করেছে।

সহিংসতা বৃদ্ধি: চুক্তি স্বাক্ষরের পরও সহিংসতা বন্ধ হয়নি। পাহাড়ে চাঁদাবাজি, খুন, এবং সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে। বরং আগে তুলনায় সংঘাত ও অপ্রীতিকর ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে আরো বেশি।

সংবিধান ও পার্বত্য চুক্তির মধ্যে সংঘাত

চুক্তির বেশ কিছু ধারা বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। মূলত সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ বাঙালি নামক একক জাতিগোষ্ঠীর একটি অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে জাতি, ধর্ম, বা গোত্রের ভিত্তিতে বৈষম্যের সুযোগ নেই। অন্যদিকে, পার্বত্য চুক্তি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে আলাদা ভৌগোলিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সুবিধা প্রদান করে। এতে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এবং একক শাসনব্যবস্থার ধারণা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

চুক্তির ভবিষ্যৎ ও করণীয়

২৭ বছর পরও পার্বত্য চুক্তি শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। কারণ এর অন্তরালে ছিল সন্তুলারমার একটি প্রহসন মূলক নাটক। তবে নিম্নবর্ণিত উদ্যোগ গ্রহণ করলে অনেকঅংশেই এর সুফল লাভ করা সম্ভব :

চুক্তি সংশোধন এর ক্ষেত্রে: চুক্তির যেসব ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, সেগুলো সংশোধন করতে হবে। জাতিগত বৈচিত্র্য ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে সংবিধানে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

চুক্তি বাস্তবায়নের তদারকি: চুক্তির দীর্ঘসূত্রতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে বাস্তবায়ন পিছিয়ে আছে। এই সদিচ্ছা সৃষ্টিতে চুক্তির সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই।

সমান সুযোগ: চুক্তি শুধু পাহাড়ি জনগণের স্বার্থ নয়, বাঙালিসহ সব সম্প্রদায়ের কল্যাণ নিশ্চিত করতে হবে।

জাতীয় স্বার্থ রক্ষা: সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশের সার্বভৌমত্তের পূর্ণ নিশ্চয়তা বজায় পূর্বক চুক্তির ধারা পুনর্গঠন প্রয়োজন।

সন্ত্রাস দমন: সশস্ত্র সংগঠন এবং অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। না হয় প্রতি নিয়ত ঘটমান ঘটনা ঘটতে থাকবে। দিন দিন পাহাড়ের অবনতি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।

ভূমি বিরোধ মীমাংসা: ভূমি মালিকানা নির্ধারণে স্বচ্ছ এবং কার্যকর নীতি গ্রহণ করতে হবে। সকল ভুমির সার্ভে করে সরকারি মালিকানা প্রকাশ করে বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।

উন্নয়ন কর্মসূচি: পাহাড়ি ও বাঙালি উভয়ের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিশ্চিত করা জরুরি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হলেও এটি বস্তুত একটি অপূর্ণ এবং বিতর্কিত উদ্যোগ হিসেবে অনেকাংশে প্রতীয়মান। “হয় সংবিধান, না হয় পার্বত্য চুক্তি সংশোধন করা আবশ্যিক”—এই দাবি আজ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। চুক্তির সফল বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান ও চুক্তির ধারাগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য আনতে হবে।
সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে জাতিগত সম্প্রীতি এবং জাতীয় সংহতি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। এটাই দীর্ঘমেয়াদে শান্তি ও উন্নয়নের পথ তৈরি করবে।

মিলগার্ট জাওহারি
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষায়ক গবেষক ও লেখক।

আপনার ইমেইল প্রদর্শন করা হবে না।