পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হিংসার লেলিহায় আধার নেমে এলো লংগদুর ৩৫ কাঠুরিয়া পরিবারে

১১২
মুক্ত মতামত
সবুজের চাদঁরে ঢাকা সুপ্র মেঘের পরশ ছোঁয়ানো এক স্বপ্নীল ও রুপময় ভূ-খন্ড পার্বত্য চট্টগ্রাম । অপার সম্ভাবনার এই ভূ-স্বর্গর্টি সর্বদা অশান্ত দূর্গম প্রতিকুল জনপদ। তার মাঝে নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা। যেখানে ৯ সেপ্টম্বর ১৯৯৬ (শান্তিচুক্তির পূর্বে) সালে সংগঠিত হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে ভয়াবহ হৃদয় বিদায়ক অমানবিক এক হত্যাকাণ্ড। যেটি পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে ভয়াবহ ও নিন্দাজনক একটি হত্যাকান্ড। বিষাদময় এ গণহত্যাটি ঘটে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় লংগদু উপজেলার অদুরে পাকুয়াখালী পাহাড়ী অঞ্চলে। এটি একটি বর্তমান আলোচিত স্থান। উপজাতি ও বাঙ্গালি সম্প্রদায়ের যৌথ বসবাস করা একটি জনপদ এটি । সব সম্প্রদায়ের জনগন এখানে কোনোমতে কাঁঠ বাশঁ কেটে জীবন যাপন করে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে এযাবৎকালে বেশ কয়েকটি গণহত্যার শিকার হয়েছে । এ সমস্ত গণহত্যা সংগঠিত করেছে পাহাড়ী বিপদগামী সন্ত্রাসী জে এস এস ও ইউপিডিএফসহ আরো সন্ত্রাসী দলগুলো। যাদের মারাত্মক অতীত এখনো আমাদের মাঝে অনেকের অজানা, কারণ বিচার না পাওয়া পরিবারগুলো ভয়ে প্রকাশ্যে সবার নিকট এ ঘটনা বলতে পারেনা। বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য কতিপয় গণহত্যার ইতিহাস বর্তমান প্রজন্মের তরুনদের না জানার লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকতে হয় আমাদের। পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতীয় সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের গডফাদার খুনি সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এর সশস্ত্র সংগঠন শান্তি বাহিনীর উপজাতি সন্ত্রাসী হায়নারা শান্তি চুক্তি পূর্ববর্তী সময়ে, প্রায় ৩০ হাজার নিরীহ বাঙ্গালী হত্যা করে। এবং শত শত গণহত্যা চালায়, যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এর মধ্যে অন্যতম হলো পাকুয়াখালী গণহত্যা।
১৯৯৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ৩০ হাজার বাঙ্গালীর হত্যাকারী খুনি সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এর সশস্ত্র সংগঠন শান্তি বাহিনীর উপজাতি সন্ত্রাসী হায়নারা উপজেলার পাকুয়াখালীতে নীরিহ এবং নিরস্র বাঙ্গালী কাঠুরিয়াদের উপর নির্মম হত্যাকান্ড চালিয়ে তাদের বিবৎস মানসিকতার এক জঘণ্যতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। স্বাধীনতার পর পরই খুনি সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এর সশস্ত্র সংগঠন শান্তি বাহিনীর ও উপজাতি সন্ত্রাসী হায়নারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু করে।
হত্যা, গুম, র্নিযাতন, চাদাঁ আদায়ের মাধ্যমে দিনদিন উম্মাদ হয়ে উঠে পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা। লংগদু পাহাড়ী জনপদে বসবাস করা বাঙ্গালী লোকগুলোর শ্রমই ছিল জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উপায়। রুজি রোজগারের সহজ বিকল্প কোন উপায় না থাকায় বনের গাছ, বাঁশ আহরণেই ছিল তাদের দুমোটো আহারের শেষ স্থান । শান্তি বাহিনী মিটিং করার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ডেকে নিয়ে ৩৫ জন নিরীহ বাঙ্গালী কাঠুরিয়াকে নির্মমভাবে হত্যা করে সেদিন। অবাক করার বিষয় হচ্ছে যে, শান্তি বাহিনী সেদিন এতগুলো মানুষকে হত্যা করতে একটি বুলেটও ব্যবহার করেনি। বিকৃত লাশ আর খন্ড খন্ড অঙ্গসহ বেশ কয়েকটি মাথা একটি বস্তায় করে আনা হয়েছিল লংগদু থানা সদরে।
প্রায় লাশের পুরুষাঙ্গ কেটে মাথাগুলোর মুখে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। প্রায় লাশের হাত সাথে ছিল না। হাত-পা বেঁধে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে, দা-দিয়ে কুপিয়ে এবং কুড়াল ও অন্যান্য দেশি অস্ত্র দিয়ে খোঁচিয়ে খোঁচিয়ে নানা ভাবে কষ্ট দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল এই অসহায় মানুষ গুলোকে। প্রতিটি লাশকেই বিকৃত করে সেদিন চরম অমানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল সন্তু জানোয়াররা। সেদিন কাঠুরিয়াদের জেএসএস সন্ত্রাসীরা পাহাড়ের থেকে গাছ,বাশঁ কাটলে নিদ্দিষ্ট হারে চাদাঁ দিতে হবে । ৩৬ জন কাঠুরিয়াকে ব্যবসায়িক লেনদেনের কথা বলে সেদিন গহীন অরণ্যে ডেকে নিয়ে যায়। তারপর তাদের মাঝে প্রথমে ভালোভাবেই কথা বার্তা চলে। কিন্ত এক পর্যায় সন্ত্রাসীরা অনেক বেশি টাকা দাবী করে । তখন কয়েকেজন তা দিতে পারবেনা বলে জানালে তাদের আলাদা স্থানে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলে। পরক্ষণে যখন বাকীরা জানতে চায় তারা কোথায় তখন তাদের ও মেরে ফেলার সিদান্ত নেয় সন্ত্রাসীরা। সেখানে কাঠুরিয়াদের তিন দিন আটকে রেখে হাত-পা ও চোখ বেঁধে নির্যাতন চালিয়ে ৯ সেপ্টেম্বর হত্যা করা হয়। আটক ৩৬ জন কাঠুরিয়ার মধ্যে ইউনুস নামের একজন কাঠুরিয়া পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। সে খবর দিলে ৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পুলিশ পাকুয়াখালীর গহীন জঙ্গল হতে ২৮ জন কাঠুরিয়ার ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে। বাকি ৭ জন কাঠুরিয়ার লাশ পাওয়া যায়নি।
এই ভীবৎস লাশের করুন চিত্র, এখনো আমাদের হৃদয়কে নাড়া দেয়। এবং এ বিষাদময় প্রহর এখনো লংগদুবাসীকে শিহরীত করে তুলে।
বিচারিক অপেক্ষায় তিন দশকের শেষের দিকে পা রাখছে পাকুয়াখালী গণহত্যা দিন। আজও বিচারের মুখ থুবড়ে আছে !!! না আছে রাষ্ট্রের দায় থেকে কিছু করা, না পারছে ক্ষতিগস্থ ব্যক্তিদের থেকে কিছু করতে। আদৌ কি বিচারের কাঠগড়ায় অপরাধীকে রাষ্ট্র নিতে পারবে? নাকি রাষ্ট্রের সহায়তায় পার পেয়ে সুখময় জীবন যাপন করছে অপরাধীরা? প্রশ্ন এটাই। সরকার চাইলে অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনতে পারে । কিন্তু আনছে না কেন? এ প্রশ্ন সচেতন মহলের । আর আরেকটি পাকুয়াখালী যাতে না ঘটে এর ব্যবস্থা কি রাষ্ট্র করছে কি না আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। যদি না নেয় তাহলে বিচারিক আদালতে মানবতার ও রাষ্ট্রের দায়ভার প্রশ্নবৃদ্ধ থেকে যাবে।
তৎকালীন পাকুয়াখালী পরিস্থিতি স্বচক্ষে দেখার জন্য সরকারের ৪ জন প্রভাবশালী মন্ত্রী লংগদু গিয়েছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম, শিল্প মন্ত্রী তোফায়েল আহম্মদ, পানি সম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক এবং শ্রম ও কর্ম সংস্থান মন্ত্রী এম.এ. মান্নান। তাঁরা লংগদু গিয়ে মানুষের বুক ফাটা কান্না আর আহাজারী দেখে হত্যাকারীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার গুলোকে পুনর্বাসন করার। ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের সন্তানদের লেখা পড়ার দায়িত্ব নেয়ার প্রতিশ্রুতিও তারা দিয়েছিলেন। লংগদু থেকে ফিরে আসার পর তৎকালীন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার সুলতান মাহমুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এই কমিটি ৩১ অক্টোবর ৯৬ ইং বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তাঁদের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এই তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। আর ঘুমন্ত সেই আদালত মানুষের মনে শুধু প্রশ্ন জম্ম দিচ্ছে আদৌ সরকার কি এর বিচার করবে?বিচারহীনতার কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা একের পর এক হত্যাকান্ড ঘটিয়েই যাচ্ছে। এটাও সত্য যে, কোন অপকর্ম করে বিচারের সম্মুখীন হবার সম্ভাবনা যদি না থাকে তাহলে অপরাধীরা অপকর্মে উৎসাহ পাবেই। তাই মানবাধিকার এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই পাকুয়াখালী গণহত্যাসহ সকল হত্যাকান্ডের তদন্তের প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করা প্রয়োজন। অন্যথায় পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা কোনদিনই সফল হবে না।

মন্তব্য বন্ধ আছে তবে ট্র্যাকব্যাক ও পিংব্যাক চালু রয়েছে।