সিনহা মামলার তদন্ত গুছিয়ে এনেছে কমিটি

0 ১৮৬

আলোকিত লংগদু ডেক্সঃ

মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান নিহত হওয়ার ঘটনা তদন্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের কাজ প্রায় গুছিয়ে ফেলেছে। কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তদন্ত প্রায় শেষের দিকে। ২৩ আগস্টের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেওয়া হবে।

গতকাল রোববার টেকনাফের শামলাপুর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গণশুনানিতে এসে কমিটির সদস্যরা এ তথ্য জানান। বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত গণশুনানি হয়। তবে গতকাল যাঁরা কমিটির কাছে সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই ঘটনাস্থলে ছিলেন না বলে জানা গেছে। তাঁরা ঘটনা শুনে পরে সেখানে আসেন।

শামলাপুর রোহিঙ্গা ক্যাম্প ইনচার্জের যে কার্যালয়ে গণশুনানি হয়েছে, সেটা শামলাপুর পুলিশের তল্লাশিচৌকি থেকে হাঁটা দূরত্বে। কমিটির প্রধান বলেন, ‘আসলে কোনো কিছু যাতে বাদ না পড়ে, সে কারণে ঘটনাস্থলের পাশের স্থানটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে। যাঁরা সেদিন ঘটনাটি দেখেছিলেন, তাঁদের আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি।’

গত ৩১ জুলাই রাত সাড়ে ৯টায় কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর পুলিশের তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন সিনহা মো. রাশেদ খান। এ ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ ২ আগস্ট চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা থাকলেও ১০ আগস্ট অতিরিক্ত আরও সাত কর্মদিবস সময় বাড়িয়ে দেয় মন্ত্রণালয়।

কমিটির অন্য তিন সদস্য হলেন সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রতিনিধি লে. কর্নেল এস এম সাজ্জাদ হোসেন, পুলিশ বাহিনীর প্রতিনিধি চট্টগ্রাম রেঞ্জের পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি জাকির হোসেন খান ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহা. শাজাহান আলী।

গতকাল গণশুনানি শুরু হলে সকাল থেকে আশপাশের শত শত মানুষ সেখানে ভিড় করেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও আসেন। তবে সাক্ষ্য দিতে রাজি হন মাত্র ১১ জন। সাক্ষ্য দিতে আসে ঘটনাস্থলের পাশের একটি মাদ্রাসার একদল শিশুও। বয়স কম হওয়ায় তদন্ত কমিটি তাদের সাক্ষ্য নেয়নি।

গণশুনানি উপলক্ষে সেখানে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়। পুলিশ, র্যা বের পাশাপাশি সেনাসদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন।

সকাল ১০টায় তদন্ত শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বৈরী আবহাওয়ার কারণে তা এক ঘণ্টা দেরিতে শুরু হয়। কমিটির সদস্যরা ইচ্ছুক লোকদের একটি কক্ষে নিয়ে বসিয়ে রেখে সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। যে কক্ষে সাক্ষ্য নেওয়া হয় তার ফটকে সেনাসদস্যরা পাহারা বসান। যাঁরা সাক্ষ্য দিতে আসেন তাঁরা সাক্ষ্য শেষে পেছনের পথ দিয়ে বাড়ি চলে যান। গণমাধ্যমের কর্মীরা তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে পারেননি।

যাঁরা সাক্ষ্য দিতে আসেন তাঁদের একজন শামলাপুরের মৎস্য ব্যবসায়ী রসিদ আহমদ। সাক্ষ্য দেওয়া শেষে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘তদন্ত কমিটি ৩১ জুলাই রাতের ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে চেয়েছে। যা দেখেছি তা–ই বলেছি।’ ঘটনার সময় তিনি শামলাপুর তল্লাশিচৌকির কাছে ব্রিজের ওপর ছিলেন বলে জানান। দূর থেকে তিনি পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকতকে চারটি গুলি করতে দেখেছেন।

বাহারছড়া ইউনিয়নের নয়াপাড়ার বাসিন্দা আনসারুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, গণশুনানিতে ডেকেছেন বলে তিনি নাম তালিকাভুক্ত করেছিলেন। কিন্তু তদন্ত কমিটি তাঁর সাক্ষাৎকার নেয়নি। ঘটনার দিন তিনি বাড়িতে ছিলেন।

অধিকাংশ সাক্ষীর ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে। কয়েকজন দিয়েছেন অন্যের ফোন নম্বর। যেমন বাহারছড়ার পশ্চিমপাড়ার জাকির হোসেন গণশুনানিতে ফোন নম্বর দিয়েছেন তাঁর শ্যালক সৈয়দ উল্লাহর।

সৈয়দ উল্লাহ বলেন, জাকির হোসেন স্ত্রীকে প্রায় সময় মারধর করেন। এ কারণে দুই মাস আগে তাঁর বোন তালাক দিয়ে বাড়িতে চলে আসেন। জাকিরের সঙ্গে তাঁদের কোনো যোগাযোগ নেই।

আরেক সাক্ষী সরওয়ার কামাল ফোন নম্বর দিয়েছেন স্থানীয় বাহারছড়া ইউপি সদস্য মো. ইলিয়াছের। সাক্ষী সাইফুল আফসার (ট্রাকচালক) ভাইয়ের নম্বর দিয়েছেন। সেটিও বন্ধ পাওয়া গেছে। তিনি রাত ১০টা ৫৭ মিনিটে ঘটনাস্থলে যান বলে জানা গেছে।

মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেছে আরও তিন সাক্ষী বাহারছড়ার পুরাতন পাড়ার আবদুল হামিদ, শামলাপুর বায়তুল নুর মসজিদের মুয়াজ্জিন মো. আমিন ও শামলাপুরের পানদোকানি মো. আলীর। মুয়াজ্জিন ও পানদোকানি ঘটনাস্থলের আশপাশে ছিলেন বলে জানা গেছে।

গণশুনানি শেষে কমিটির প্রধান মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। তিনি বলেন, গতকালের গণশুনানিতে মোট ১১ জন তাঁদের নাম তালিকাভুক্ত করেন। কিন্তু দুজনের সাক্ষ্য নেয়নি কমিটি। এ নিয়ে কমিটি মোট ৬০ জনের সাক্ষ্য নিয়েছেন বলে জানান তিনি।

কয়েক দিন ধরে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, টেকনাফ থানা–পুলিশ, ফাঁড়ির পুলিশ, গাড়িচালক, ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক, সুরতহাল প্রস্তুতকারী কর্মকর্তাসহ অনেকের বক্তব্য নিয়েছে তদন্ত কমিটি। কমিটি বিভিন্ন সংস্থায় চিঠি দিয়ে কোনো তথ্য থাকলে তা জানাতে বলে।

এটি ফৌজদারি মামলা, এর সঙ্গে জড়িত আসামিরা গ্রেপ্তার হয়েছেন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সেই মামলা তদন্ত করছে। তাহলে এ কমিটির প্রতিবেদন কী কাজে আসবে, জানতে চাইলে কমিটির প্রধান বলেন, ‘এটা মামলার কাজে লাগবে কি না, সেটা সরকার বুঝবে। আমরা সরকারকে প্রতিবেদন দেব, সেটা সরকার বুঝবে।’ ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে সরকারি বাহিনীগুলোর ভেতরে কোনো সমন্বয়হীতা দেখছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, আমি সেটা পাইনি। আমি সবার সমান সহযোগিতা পেয়েছি।’

সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌসের করা মামলার প্রধান আসামি করা হয় বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলী এবং ২ নম্বর আসামি করা হয় টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে। এ দুজন ছাড়া মামলায় আরও সাত পুলিশ সদস্যকে এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়। পরে ওই মামলায় তদন্তকারী সংস্থা র্যা ব আরও তিনজনকে আসামি করে প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে।

আলোচিত এ মামলায় অন্য আসামিরা হলেন এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এএসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোহাম্মদ মোস্তফা। টুটুল ও মোস্তফা পলাতক রয়েছেন।প্রথম আলো

আপনার ইমেইল প্রদর্শন করা হবে না।