কোরবানি মুমিনের আত্মত্যাগের নিদর্শন
কোরবানি শব্দটি আরবি; যার বাংলা হলো আত্মত্যাগ, সান্নিধ্য। অর্থাৎ পরম করুণাময়ের সান্নিধ্য পাওয়ার উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট তারিখে প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের হালাল উপায়ে অর্জিত হালাল ও বলবান পশু আল্লাহর নামে জবাই করাই কোরবানি। হজরত ইবরাহিম আ:-কে যখন আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয়তম পুত্র ইমাইল আ:-কে কোরবানির বদলে পশু জবাইয়ের নির্দেশ দেন তখন থেকেই এ আদেশ কার্যকর হয় জিলহজ মাসের ১০ তারিখে। একদা হজরত জায়েদ ইবনে আকরাম রা: রাসূল সা:-এর কাছে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, কোরবানি কী? উত্তরে রাসূল সা: ইরশাদ করলেন, ‘কোরবানি হচ্ছে তোমাদের আদি পিতা হজরত ইবরাহিম আ:-এর জীবনাদর্শ’। সাহাবি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, কোরবানির ফজিলত কী? রাসূল সা: বললেন, ‘পশুর প্রত্যেকটি পশমের পরিবর্তে একটি নেকি দেয়া হয়।’ (মেশকাত-১২৯)
ব্যক্তির কোরবানি উত্তম ও বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য পশু নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তায়ালা কোরবানির জন্য ছয় ধরনের পশু ও তাদের বয়স নির্ধারণ করে দিয়েছেন যার বহির্ভূত কোরবানি বিশুদ্ধ হবে না। ছয় ধরনের পশু ও তাদের বয়স যথা- পাঁচ বছর বয়সী উট, দুই বছর বয়সী গরু ও মহিষ এবং ছাগল, ভেড়া। দুম্বার বয়স হতে হবে ন্যূনতম তিন মাস। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- কোরবানির পশু অবশ্যই যতটা পারা যায় সুন্দর, বলিষ্ঠ ও ত্রুটিমুক্ত হতে হবে। কেননা, আল্লাহ তায়ালা প্রিয় ও স্নেহের বস্তু ত্যাগের মাধ্যমেই বান্দাকে ত্যাগের শিক্ষা দিতে চান যাতে সে অন্য কোনো নগণ্য বস্তু ত্যাগে পিছপা না হয়। এ বিষয়ে মুসলিম শরিফের এক হাদিসে রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘তোমরা মোটাতাজা পশু দেখে কোরবানি করো, কারণ এ পশুই পুলসিরাতের বাহক হবে’। (মুসলিম-২৬২৯)
অনেক সময় পশুর বয়স নিয়ে সন্দেহ থাকে তাই আল্লাহ বয়স সহজে নির্ণয় করার জন্য পশুর সামনের পাটিতে দু’টি দাঁত গজানোর ব্যবস্থা করেছেন। এই দুটো দাঁত উঠে গেলে নিঃসন্দেহে পশুটি কোরবানিযোগ্য হবে। তবে প্রাপ্তবয়স্ক অথচ দাঁত উঠেনি এমনটা বিরল হলেও ঘটে। এ প্রসঙ্গে হজরত জাবের রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘তোমরা অবশ্যই মুসিন্না (প্রাপ্তবয়স্ক) পশু কোরবানি করবে তবে তা তোমাদের জন্য দুষ্কর হলে ছয় মাসের মেষশাবক কোরবানি করতে পারো।’ (মুসলিম)
কোরবানির গ্রহণযোগ্যতা বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সৃষ্টিকর্তা একমাত্র মুত্তাকিদের কোরবানি কবুল করেন।’ (সূরা মায়িদা-২৭) অর্থাৎ, যারা তাকওয়াবান ও আল্লাহর সব বিধিনিষেধ মেনে কোরবানি করেন এবং ভুল ও অসৎ উপার্জনকে বর্জন করেন আল্লাহ কেবল তাদের কোরবানিই কবুল করেন এবং সেই কোরবানির পশু তার পুলসিরাতের বাহক হবে। এমন ব্যক্তির কোরবানি গ্রহণ করা হবে না যে কেবল গোশত ভক্ষণ করার জন্য বা লোক দেখানোর জন্য অধিক মূল্যের পশু কোরবানি করে।
সূরা হজের অপর এক আয়াতে আল্লাহ কোরবানির গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মাতের জন্য কোরবানি নির্ধারণ করেছি যাতে তারা হালাল পশু জবাই করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ আল্লাহ তায়ালা সামর্থ্যবান বান্দা এবং তার গরিব পাড়া-প্রতিবেশী যাতে ঈদ তথা আল্লাহর পক্ষ থেকে নিমন্ত্রণ উপলক্ষে হালাল ও সুস্বাদু গোশত ভক্ষণ করতে পারে সে জন্যই এই নির্দেশ। কোরবানি নতুন কোনো প্রথা নয়, এটি আদিকাল থেকে আল্লাহর নির্দেশে চলে আসছে। আদম আ:-এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের মধ্যে যখন বিয়েশাদী নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয় তখন আল্লাহ ইখলাসের সাথে দুজনকেই কোরবানির নির্দেশ দেন যার কোরবানি কবুল হবে তার ইচ্ছেই পূরণ হবে।
কোরবনি কবুলের দ্রুততা প্রসঙ্গে রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই কোরবানিদাতার কোরবানি আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায় এবং তার অতীতের সব গুণাহ মোচন করে দেয়া হয়।’ (তিরমিজি-১/১৮০)
হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: বলেন, ‘কোরবানির দিন আল্লাহর কাছে কোরবানি অপেক্ষা উত্তম কোনো আমল আর নেই’।
কোরবানি এমন একটি ইবাদত যা আমাদের ত্যাগ, সামাজিকতা, আত্মিয়তার বন্ধন সুদৃঢ় করার শিক্ষা দেয়ার পাশাপাশি নিজেদের হালাল গোশতের চাহিদা পূরণের মাধ্যম হিসেবে আরোপ করেন। আল্লাহ তায়ালা কোরবানির গোশতকে তিন ভাগে তথা কোরবানিদাতা, মিসকিন, প্রতিবেশী ও আত্মীস্বজনের মধ্যে বণ্টনের নির্দেশ দেন এবং পশুর চামড়া বিক্রির টাকা গরিবদের হক। এর মাধ্যমে ধনী-গরিবের বৈষম্য কমে, সমাজের সবাই একই সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারে। এ জন্যই ইসলাম সব থেকে সুন্দর ও সহজ।
লেখক : শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
মন্তব্য বন্ধ আছে তবে ট্র্যাকব্যাক ও পিংব্যাক চালু রয়েছে।