ঈদুল আযহার তাৎপর্য ও আমল
।। মুহাম্মদ আমিনুর রশিদ ।।
عيد ( ঈদ) আরবী শব্দটি আরবী । عيد অর্থ হল আনন্দ, উৎসব, পূণরাগমন, পুনরাবৃত্তি, বার বার পিরে আসা ইত্যাদি। আরবী ভাষাবিদগণ বলেন, عود ( د – و – ع) বর্ণ সমৃদ্ধ ধাতু হতে ঈদ শব্দটি গঠিত। আর الاضحٰى ( আল-অয্হা) শব্দটি আরবী । এর অর্ত কোরবানী, Sacrifice । প্রতি বৎসর পবিত্র জিলহাজ্ব মাসের ১০ তারিখ মহান আল্লাহর নামে নির্দিষ্ট পশু কোরবানীর মাম্যমে খুশি ও আনন্দ উদযাপন করার দিবসالاضحٰى عيد ( ঈদুল আযহা) বা কুরবানীর ঈদ বলা হয়। প্রতি বৎসর পর্যায়ক্রমে এই ঈদের পূনরাগমন হয় বলেই একে ঈদ বলে ।
যে কোন জাতি বা সম্প্রদায়ের খুশি – আনন্দের জন্য আছে নির্দিষ্ট দিন বা সময়। তেমনিভাবে আরবের মদিনাবাসীও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আগমনের পুর্বে নির্ধারিত দিনে আনন্দ – উৎসব উদযাপন করত। তারা মিহিরজান ও নওরোজ ( বা নায়মুক) নামে দুইটি দিবসে ক্রিড়া ও উৎসব পালন করত। যেহেতু এই উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত ক্রিড়া, খেলাধুলা ও আনন্দ- উৎসবের আয়োজনের মধ্যে কোন কিছুই ইসলামী বিধান মোতাবেক ছিলনা। তাই রাসুল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় তাশরিফ আনার পর তাদেরকে জিজ্ঞাস করেন, এদিন তোমাদের আনন্দ- উৎসব উদযাপনের কারণ কি? তারা বলেন, জাহিলিয়াতের যুগে আমরা এ দুইদিন খেলাধূলা ও উৎসব করতাম। তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ তায়ালা তোমাদের এই দুদিনের বিনিময়ে অন্য দুটি উত্তম দিন দান করেছেন এবং তা হল “ঈদুল ফিতর” ও “ঈদুল আযহা”।
এব্যাপারে সুনানে আবু দাউদে হযরত আানাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় পৌঁছে দেখতে পান যে, সেখানের অধিবাসীরা বছরে দুদিন (নায়মুক ও মিহিরজান) খেলাধুলা ও আনন্দ উৎসব করে থাকে। তিনি (রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) জিজ্ঞাস করেন এ দুটি দিন কিসের? তারা বলেন, আমরা জাহিলিয়াতের যুগে এদুইদিন খেলাধূলা ও উৎসব করতাম। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ তায়ালা তোমাদের এই দুদিনের বিনিময়ে অন্য দুটি উত্তম দিন দান করেছেন এবং তা হলঃ কোরবানী ও রোজার ঈদের দিন।
সুত্র: সুনানে আবু দাউদ, খন্ড-০২, পৃ:-১৩৯,হাদিস নং-১১৩৫, (ইফা বাংলা)
ঈদুল আযহা মহান আল্লাহর বিশেষ উপহার:
প্রতি বৎসরের ঈদুল আযহা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে মুসলিম উম্মাহর জন্য বিশেষ উপহার। আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের জন্য এইটি বড় একটি মাধ্যম। ঈদুল আযহার দিন কেুরবানী করার চেয়ে অধিক প্রিয় আমল নয়। উম্মুল মোমিনীন হযরত আয়শা রা. বর্ণনা করেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ঈদুল আযহা দিবসে রক্ত প্রবাহিত করন( অর্থ পশু জবেহ করা) ব্যাতিত বণি আদমের জন্য অন্য কোন আমল আল্লাহ তায়ালার দরবারে অধিক প্রিয় নয়। কিয়ামতের দিন কুবানীকৃত পশুকে উহার শিং, লোম ও খুর সহ উপস্থিত করা হবে এবং নেকীর পাল্লায় ওজন করা হবে। আর কুরবানীর পশুর রক্ত মাটিতে পতিত হওয়ার পূর্বেই আল্লাহ তায়ালার দরবারে কবুল হয়ে যায়। সুতারাং এই সমস্ত নেকীর দিকে লক্ষ করে কুরবানী করিয়া সন্তুষ্ট থাক। তিরমিযি- হাদিস নং -১৪৯
ঈদুল আযহার দিনের সুন্নত সমুহ:
প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম রা. পবিত্র ঈদুল আযহার দিনে বিশেষ কিছু আমল করতেনঃ যা মুসলিম উম্মাহর নিকট সুন্নত হিসাবে পরিচিত। ঈদুল আযহার পালনীয় সুন্নত সমুহ নিম্মে দেওয়া হল।
১. প্রত্যুষে ঘুম থেকে উঠা।
২. মিসওয়াক করা ।
৩. গোসল করা।
৪. যথাসাধ্য পবিত্র ও উত্তম পোষাক পরিধান করা।
৫. আতর/সুগন্ধি ব্যবহার করা।
৬. শরীয়ত সম্মত সাজ-সজ্জা করা।
৭. (সম্ভব হলে) এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া এবং অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরে আসা।
৮. তাকবীরে তাশরীক উচ্চস্বরে পাঠ করতে করতে ঈদগাহে যাওয়া।
৯. ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে কোন কিছু আহার না করা।
১০. ঈদের নামাজ আদায় করার পর নিজের কুরবানীর গোস্ত হতে প্রথমে আহার করা।
১১. ঈদগাহে তারাতারী যাওয়া ।
১২. কোন ওজর না থাকলে ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া।
১৩. ঈদের নামাজ ঈদগাহে আদায় করা। ( যদি কোন সমস্যা না থাকে)
১৪. ঈদের নামাজের আগে ঘরে বা ঈদগাহে এবং পরে ঈদগাহে নফল নামাজ না পড়া।
ঈদের রাতের ফজিলত:
ঈদের দিন যেভাবে আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের জন্য আনন্দ উপভোগ ও তাঁর নৈকট্য লাভের বিভিন্ন কর্মসুচীর ব্যবস্থা রেখেছেন। তেমনিভাবে তিনি ঈদের রাতকেও ফজিলতপূর্ন রাত হিসাবে ঘোষণা করেছেন। বান্দা তার আনন্দ উৎসবের মধ্যেও যখন তার প্রভুকে রাত জেগে স্বরণ করবে এবং আপন মালিককে ডাকবে, রাহমানুর রাহিম মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে আপন রহমতের ছাদরে ঢেকে রাখবেন। দয়াময় প্রভু ঘোষনা করবেন তার জন্য জান্নাতের সু-সংবাদ। সাথে সাথে বান্দার গোনাহ সমুহ ক্ষমার ঘোষণা তিনি দিতে থাকবেন। এই বিষয়ে হাদিস শরীফে অসংখ্য হাদিস বর্ণি হয়েছে। নিম্মে কয়েকটি হাদিস বর্ণনা করা হল।
১.হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত –
عن معاذ بن جبل -رضي الله عنه- قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: من أحيا الليالي الخمس وجبت له الجنة، ليلة التروية، وليلة عرفة، وليلة النحر،وَلَيْلَة الْفطر وليلة النصف من شعبان .
হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যাক্তি পাঁচটি রাত (ইবাদতের উদ্দেশ্যে) জাগ্রত থাকবে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে। তারবিয়ার রাত( জিলহাজ্ব মাসের আট তারিখের রাত) আরাফাতের রাত, কুরবানীর দিবসের রাত ( ঈদুল আযহার রাত), ঈদুল ফিতরের রাত।
সুত্র: আততারগীব ওয়াত তারহীব লিল অসবাহানী, প্রথম খন্ড-২৪৮ পৃষ্ঠা, লিল মুনজেরী ২/৯৮, হাদিস নং-১৬৫৬।
২.হযরত আবু উমামা রা. থেকে বর্ণিত হাদিস:-
عَنْ أَبِي أُمَامَةَ، عَنْ النَّبِيِّ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -، قَالَ:”مَنْ قَامَ لَيْلَتَيْ الْعِيدَيْنِ مُحْتَسِبًا لِلَّهِ، لَمْ يَمُتْ قَلْبُهُ يَوْمَ تَمُوتُ الْقُلُوبُ”
হযরত আবু উমামা রা. রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণণা করেন, যে ব্যাক্তি ঈদুল ঠফতর ও ঈদুল আযহার রাত্রে (ইবাদতের উদ্দেশ্যে) জাগ্রত থাকবে, সে ব্যাক্তির হৃদয় ঐদিন মৃত্যুবরণ করবে না যে দিন হৃদয়গুলো মৃত্যুবরণ করবে। ( অর্থাৎ কিয়ামতের দিন তার কোন ভয় থাকবেনা।) সুত্র: ইবনে মাজাহ2য় খন্ড, হাদিস নং-১৭৮২
৩. হযরত উবাদা রা. থেকে বর্ণিত হাদিস:-
عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «مَنْ صَلَّى لَيْلَةَ الْفِطْرِ وَالْأَضْحَى، لَمْ يَمُتْ قَلْبُهُ يَوْم تَمُوتُ الْقُلُوبُ»
হযরত উবাদা রা. থেকে বর্ণিত রাসুল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যাক্তি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার রাত্রি নামাযরত অবস্থায় থাকবে, সে ব্যাক্তির হৃদয় ঐদিন মৃত্যুবরণ করবেনা যে দিন অন্য হৃদয়গুলো মৃত্যু বরণ করবে। সুত্র: আল মুজামুল আওসাত–খন্ড০১, হাদিস নং ১৫৬।
এছাড়াও আরো অসংখ্য হাদিসে দুই ঈদের রাত্রের ফজিলত ও তাৎপর্য বর্ণিত হয়েছে। যা প্রমাণ করে প্রত্যেক মুমিন- মুসলমমানের জীবনে ঈদের রাতের গুরুত্ব অপরিহার্য। আসুন আমরা সকলেই দুই ঈদের মুল্যবান ও ফজিলতপুর্ণ রাত্রে ইবাদত, তাসবীহ, তাহলিল, জিকিরি – আযকার, কুরআন তিলাওয়াত ও তাহাজ্জুদের নামাজ আদায়ের মাধ্যমে মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে হাজিরী দিয়ে তাঁর রেজামন্দি, মাগফিরাত, রহমত ও বরকত কামনা করি।
লেখক পরিচিতি:
মুহাম্মদ আমিনুর রশিদ
খতিব, বায়তুশ শরফ জামে মসজিদ
সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি
লংগদু উপজেলা শাখা, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা।