পাহাড়ে অশান্তি, চাকমা রাণী ইয়েনের ভূমিকা নিয়ে যত অভিযোগ

৭৭

ডেস্ক রিপোর্টঃ

দেশের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিরতা আর নৈরাজ্যের পেছনে চাকমা রাণী ইয়েন ইয়েনের ইন্ধন রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধু তা-ই নয়, তার কর্মকান্ডে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশ এবং দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর সুনাম ও মান মর্যাদা ক্ষুণ হচ্ছে। তিনি মানবাধিকারের আড়ালে দেশ বিরোধী অপতৎপরতায় লিপ্ত বলেও অভিযোগ আছে। দেশ-বিদেশে তার সার্বিক তৎপরতা তদারক করে এমন কিছু সংস্থার প্রাপ্ত তথ্য, এমনকি তার ফেসবুক পেইজেও বিতর্কিত তৎপরতার প্রমাণ মিলেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, চাকমা সার্কেল চীফের সাথে বিয়ের পর থেকেই তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ইস্যুতে সবসময় সক্রিয় রয়েছেন। সাধারণ উপজাতিদের মধ্যে বাঙালি বিদ্বেষী মনোভাব সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও সেনাবাহিনী বিরোধী মিথ্যা তথ্য, অপপ্রচারসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে লিপ্ত রয়েছেন। তার সাম্প্রতিক কিছু কর্মকা-ে ব্যাপক বিতর্ক এবং সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে।

ইয়েন ইয়েন চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের দ্বিতীয় স্ত্রী। চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি গত ২০১৪ সালের ৪ জুলাই ইয়েন ইয়েনের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। জাতিগতভাবে ইয়েন ইয়েন রাখাইন সম্প্রদায়ের। এছাড়া, বান্দরবানের উজানিপাড়া ও ঢাকার শেওড়াপাড়ায় তার পৈত্রিক বাড়ি রয়েছে। ইয়েন ইয়েন পূর্বে বান্দরবানে পিস নামক একটি এনজিওর পরিচালনা কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিনি উপজাতিদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দাবি করেন। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের ২৩ক অনুচ্ছেদের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ২০১০ সালে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশে বসবাসকারী ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে উপজাতি হিসেবে অভিহিত করতে বলা হয়েছে। এছাড়াও, পার্বত্য চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে ‘উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল’ হিসেবে বর্ণিত আছে এবং আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদের বিভিন্ন ধারায় ‘উপজাতি’ শব্দটি বলবৎ থাকবে বলে স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ রয়েছে। এরপরও ইয়েন ইয়েন পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতিদের আদিবাসী হিসেবে উল্লেখ করে উপজাতিদের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের চেষ্টাসহ বিভিন্ন অপতৎপরতায় নিয়োজিত থাকার পাশাপাশি উপজাতিদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছেন।

অভিযোগ রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত যেকোনো ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের ঘটনায় ইয়েন ইয়েন খুব দ্রুতই বাঙালিদের ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দোষ চাপিয়ে থাকেন। তার এই একপাক্ষিক অবস্থান অনেক সময় বাস্তব ঘটনা, প্রমাণ বা তদন্তের ফলাফলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের অভিমত-এমন আচরণ শুধু ঘটনার প্রকৃত কারণ বা রহস্য উদঘাটনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে না, বরং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনা ও পারস্পরিক বিরোধ আরো বাড়িয়ে তোলে। ইয়েন ইয়েনের এমন প্রবণতা পার্বত্য অঞ্চলে সামাজিক শান্তি, সহাবস্থান ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করার ঝুঁকি তৈরি করে, যা সমস্যা সমাধানের বদলে পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে।

স্থানীয় প্রশাসনের অভিযোগ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টিতে ইন্ধন দিচ্ছেন তিনি। পাহাড়ি-বাঙালিদের মাঝে যখনই কোনো সামাজিক, প্রশাসনিক বা ব্যক্তিগত ইস্যু তৈরি হয়, তখনই ইয়েন ইয়েন উক্ত পরিস্থিতিকে এজেন্ডা বাস্তবায়নের স্বার্থে ব্যবহার করে দুপক্ষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলেন। তিনি বিভিন্ন ঘটনার প্রকৃত কারণ বা তথ্য গোপন রেখে একপাক্ষিক ব্যাখ্যা দিয়ে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে বাঙালিদের বিরুদ্ধে উস্কানি দেন। যেন সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয় এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। এছাড়া, ইয়েন ইয়েন বিভিন্ন অপ্রমাণিত ইস্যুকে কেন্দ্র করে উস্কানিমূলক বক্তব্য ও ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে উপজাতিদের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনেরও অপচেষ্টা করে থাকেন।

স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, গত বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বর ইয়েন ইয়েন উপজাতি ছাত্র ও যুবকদের নিয়ে বেশ কয়েকটি বড় সভা-সমাবেশের আয়োজন করেন। সেখানে দেওয়া তার বক্তব্যে পার্বত্য অঞ্চলের পরিবেশকে উত্তপ্ত হয়। পরবর্তীতে এর জের ধরে পাহাড়ে রক্তাক্ত সংঘাতের ঘটনা ঘটে। অভিযোগ রয়েছে তিনি ফেসবুক স্ট্যাটাসে দেশ ও নিরাপত্তা বাহিনী বিরোধী নানাবিধ বিতর্কিত মন্তব্য করার পাশাপাশি বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে উপজাতি-বাঙালিদের উস্কে দেন। এসব বিতর্কিত মন্তব্য ও গুজবের জের ধরে পার্বত্য এলাকায় উপজাতি-বাঙালি সাম্প্রদায়িক সংঘাতের সৃষ্টি হয়।

অভিযোগ আছে বিলাইছড়িতে মারমা কিশোরীর কথিত ধর্ষণ ঘটনায় আদালতের আদেশ অবমাননা ও সেনাবাহিনী বিরোধী অপপ্রচারে তার ভূমিকা রয়েছে। বিগত ২০১৮ সালের ২২ জানুয়ারি বিলাইছড়ি জোনের ফারুয়া আর্মি ক্যাম্প থেকে উরাইছড়ি উত্তরপাড়া এলাকায় একটি এলআরপি পরিচালনা করার সময় দুই জন উপজাতি মারমা কিশোরীকে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য কর্তৃক কথিত ধর্ষণের খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এরপর, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর ভাবমর্যদা ক্ষুণœ করার অপচেষ্টার অংশ হিসেবে উপজাতীয় নারীদের ব্যবহার করে স্পর্শকাতর বিষয়টিকে ইস্যু করার জন্য ইয়েন ইয়েন মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। এছাড়াও, আদালতের আদেশ অগ্রাহ্য করে ইয়েন ইয়েন কয়েকজন কর্মীকে সাথে নিয়ে রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতালে প্রবেশ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক মারমা কিশোরীদ্বয়কে তার পিতামাতার কাছে হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় বাধা প্রদান করেন। উল্লেখ্য, পরে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য কর্তৃক উল্লেখিত ধর্ষণের ঘটনাটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়।

আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সেনাবাহিনী বিরোধী কার্যকলাপেও তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা ও বাঙালিদের বিতাড়িত করার পাশাপাশি সেনা প্রত্যাহারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইয়েন ইয়েন আন্তর্জাতিক ফোরামে বিভিন্ন বিতর্কিত এবং মিথ্যা ইস্যুকে কেন্দ্র করে পোস্টার-প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন, সভা-সমাবেশ আয়োজন ও মানববন্ধন করে থাকেন। এছাড়া, তিনি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন এনজিও সংস্থার প্রতিনিধির কাছে বাংলাদেশ সরকার ও সেনাবাহিনী বিরোধী বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপণ করেন। এতে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমর্যদা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে যেকোনো নাশকতামূলক ঘটনার প্রকৃত কারণ উদঘাটনের আগে তিনি বিশেষ একটি পক্ষ গ্রহণ করে থাকেন। এক্ষেত্রে তার উত্তেজনা সৃষ্টিকারী পোস্টসমূহ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইউপিডিএফ (মূল) দলে অনলাইন একটিভিস্ট এবং তাদের সহযোগী সংগঠনের সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপজাতিরা তার কাছে সহায়তার জন্য না গেলেও তিনি নিজে ডেকে নিয়ে বা উপস্থিত হয়ে সংঘটিত ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা করে থাকেন। সর্বোপরি পার্বত্যাঞ্চলে সংঘটিত প্রমাণিত এবং অপ্রমাণিত সকল ধরনের নাশকতার ক্ষেত্রে তিনি সরাসরি সেনাবাহিনীর ওপর দায় চাপিয়ে থাকেন।

গত বছরের ৩ জুলাই ঢাকাস্থ ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন দূতাবাসের তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি দল ট্যাংগা এনজিও অফিসে আলাপকালে ইয়েন ইয়েন বেশ কিছু অভিযোগ করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-বিগত ২৭ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে পার্বত্য চুক্তির কোনো ধারা বাস্তবায়িত হয়নি, এই কারণে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য তিনি বিশেষভাবে নিরাপত্তা বাহিনীসমূহকে দায়ী করেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা থেকে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারের প্রস্তাবনা থাকলেও তা প্রত্যাহার না করে বরং আরো ক্যাম্প বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে মিথ্যাচার করেন তিনি। উপজাতীয়দের জমি বিভিন্ন স্থানে বাঙালিরা দখল করছে এমন অভিযোগ করে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় একটি অ্যাডভোকেসি গ্রুপ তৈরি করে তার মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্যগুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরতে প্রস্তাব করেন।

এছাড়া, বিদেশে অনুষ্ঠিত সেমিনার ও সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ করে দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন এবং রাষ্ট্রীয় নীতি সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান করেন। অভিযোগ রয়েছে এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি বিদেশি সংগঠন, মানবাধিকার ভিত্তিক গ্রুপ ও প্রবাসী মহলের কিছু অংশকে দেশের বিরুদ্ধে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন, যা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে এবং কূটনৈতিক পর্যায়ে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তিনি বিভিন্ন অপতথ্য ছড়িয়ে আন্তর্জাতিক মহলে দেশের বিরুদ্ধে জনমত তৈরির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলশ্রুতিতে, বিগত ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি রিঙ্কেন ইয়েন ইয়েনকে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর কথিত বিভিন্ন সহিংসতা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিগোচর করায় বর্ণ বৈষম্যবিরোধী বৈশ্বিক চ্যাম্পিয়ন-২০২৩ এর পুরস্কার প্রদান করেন। এছাড়াও, তিনি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিভিন্ন ফেলোশিপে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ সম্পর্কে নানা ধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মিথ্যা বিবৃতি প্রদান করেন।

মন্তব্য বন্ধ আছে