আর্তমানবতার সেবায় ওলামা-মাশায়েখ

0 ২৪৩

সাম্প্র্রতিক সময়ে দুস্থ, নিরন্ন, দারিদ্র্যপীড়িত ও কোভিড-১৯ মহামারীতে আক্রান্ত গণমানুষের সেবায় আলিম-ওলামা ও পীর-মাশায়েখদের ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন যে সেবাধর্মী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে, তা এই দেশের সমাজসেবার ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এত দিন আলিম, ওলামা ও মাশায়েখ মসজিদ, মাদরাসা, খানকাহ, ওয়াজ ও নসিহতের মাধ্যমে সমাজ বিনির্মাণের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। তাদের এই অব্যাহত প্রয়াসের ফলে সমাজের তৃৃণমূলে আদর্শ ও নৈতিকতার আবহ তৈরি হয়। তারা সর্বদা মাদক, সন্ত্রাস, যৌতুক, ইভটিজিং ও সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার। এখন তারা নারী-পুরুষ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে এসেছেন। সামাজিক শক্তির প্রতিভূ হিসেবে ওলামাদের প্রতি রয়েছে সাধারণ জনগণের আস্থা ও নির্ভরতা। দেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার কোটি কোটি মানুষ আলিম-ওলামা ও পীর মাশায়েখদের ভালোবাসেন এবং সম্মানের চোখে দেখেন। তাদের ব্যাপক সেবাকার্যক্রম জনগণের গ্রহণযোগ্যতা, আস্থা ও প্রশংসা কুড়িয়েছে।
যেখানে রোগ-শোক, ভাঙন-জলোচ্ছ্বাস, প্লাবন-ঘূর্ণিঝড়, অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা, অক্সিজেন সাপ্লাই, করোনায় আক্রান্ত লাশের কাফন-দাফন, অমুসলিমদের সৎকার, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, স্যানিটারি শৌচাগার নির্মাণ, এতিমের প্রতিপালন, অনাথের বিয়ে, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের শিক্ষা প্রদান ও পুনর্বাসন, বানভাসি মানুষদের খাবার ও নগদ অর্থ বিতরণের প্রয়োজন পড়ে সেখানে ওলামা-মাশায়েখের পক্ষে স্বেচ্ছাসেবকরা হাজির।
২০১৭ সালে মিয়ানমারে রাষ্ট্রীয় সহিংসতার তাণ্ডবের মুখে বাস্তুভিটা ছেড়ে ১০ লাখ ভয়ার্ত রোহিঙ্গা শিশু, নারী ও পুরুষের ঢল নেমেছিল কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ সীমান্ত অঞ্চলে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি আশ্রয়হীন এসব জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন, অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবায় এগিয়ে আসেন ইমাম-খতিব ও ওলামা মাশায়েখ। আর্তমানবতার সেবায় তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিনিদ্র রজনী যাপন করেছেন। ওলামায়ে কেরাম তাদের সংস্থার অর্থায়নে বিভিন্ন ক্যাম্পে অগভীর ও গভীর নলকূপ, স্যানিটারি ল্যাট্রিন ও শত শত মসজিদ তৈরি করে দেন এবং কুরআন শিক্ষার আয়োজন করেন। ওলামা পরিচালিত সেবাকার্যক্রমে আন্তরিক সহায়তা প্রদান করেন সেনাবাহিনীর অফিসার ও সদস্যরা।
সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যার কারণে বিভিন্ন জেলার দুর্গম এলাকার যেসব পরিবার আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে তাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন আলেমসমাজ। তাঁবু, গৃহনির্মাণসামগ্রী, শুকনো খাবার, স্যালাইন, লাইটার, চাল, ডাল, লবণ, আলু, পেঁয়াজ এমনকি গবাদিপশুর জন্য খড়-খৈল সরবরাহ করেছেন তারা।
ইমাম-ওলামা-মাশায়েখ পরিচালিত সেবাসংস্থাগুলোর মধ্যে যাদের তৎপরতা জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে, আল্লামা ফজলুল্লাহ (রহ:) ফাউন্ডেশন, বায়তুশ শরফ আঞ্জুমানে ইত্তেহাদ, আল-মারকাজুল ইসলামী, আল-মানাহিল ফাউন্ডেশন, আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন, ইকরামুল উম্মাহ ফাউন্ডেশন, জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদ, তাকওয়াহ ফাউন্ডেশন, এহইয়াউস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন, আস-সিরাজ ফাউন্ডেশন ও আদ-দোহা সমাজকল্যাণ সংস্থাসহ অনেক ছোট-বড় সেবাসংস্থা।
ওলামা-মাশায়েখ কর্তৃক পরিচালিত সেবা সংস্থাগুলোর বাইরেও শত শত এনজিও রয়েছে যারা এ দেশে বহুমুখী মানবিক সেবাকার্যক্রম চালিয়ে আসছে, আমরা তাদের ভূমিকা ও অবদানকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করি। যেসব সংস্থা বিধি লঙ্ঘন করে মানুষের অভাবকে পুঁজি করে ধর্মবিশ্বাস পরিবর্তনে বাধ্য করে অথবা যাদের তৎপরতায় আগামীতে ভূরাজনৈতিক সঙ্কট তৈরি হতে পারে, তাদের কার্যক্রম বিশেষ নজরদারিতে এনে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। ভারত সরকার মিজোরাম ও নাগাল্যান্ডের সীমান্ত এলাকায় সক্রিয় কিছু এনজিওকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানের ঘটনাপ্রবাহ থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা নেয়ার অনেক কিছু আছে।
চট্টগ্রামের সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার সংসদ সদস্য মাওলানা ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী কর্তৃক ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘আল্লামা ফজলুল্লাহ (রহ:) ফাউন্ডেশন’ মানবিক সেবাকার্যক্রমে এগিয়ে রয়েছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও এনজিও ব্যুরোতে নিবন্ধিত এই সংগঠন সৌদি আরব, কুয়েত, ওআইসি, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, আলজেরিয়ার বিভিন্ন দাতাসংস্থা ও এজেন্সির সাথে সমন্বয় করে মানবিক সেবাকার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশে।
আল্লামা ফজলুল্লাহ (রহ:) ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মাওলানা ড. আবুল আ’লা মুহাম্মদ হোছামুদ্দিন ‘নয়া দিগন্ত’-কে বলেন, বিগত দুই বছরে ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে তিন হাজার পরিবারে কোরবানির গোশত, ১০ হাজার পরিবারে ইফতার সামগ্রী, ৫০ হাজার পরিবারে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়। এই সময়ের মধ্যে ২০০টি গভীর নলকূপ, ৫০০টি অগভীর নলকূপ, রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ সারা বাংলাদেশে অজুখানাসহ ৩০টি মসজিদ, আমিরাত পল্লী, কুয়েত পল্লী, কাতার পল্লী, ওআইসি পল্লী নির্মাণের মাধ্যমে ২২৯ গৃহহীন পরিবারকে আশ্রয়ণের ব্যবস্থা করা হয়। আমিরাত ও ওআইসি পল্লী নির্মাণ করা হয়েছে বাগেরহাট ও মাদারীপুরের সিডর উপদ্রুত এলাকায়। প্রতিটি পল্লীতে রয়েছে পরিবারের জন্য বাড়ি, স্যানিটারি মেডিক্যাল সেন্টার, মসজিদ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিগত দুই বছরে ২০ হাজার রোগীকে চিকিৎসা সেবা ও বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করা হয়। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১০ হাজার অস্থায়ী ঘর, ৩০০টি টয়লেট, ৫৬০টি সোলার লাইট স্থাপন করা হয় ফাউন্ডেশনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে।
বায়তুশ শরফের কীর্তিমান মনীষী শাহ সুফি মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল জব্বার (রহ:)-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে হজরত আল্লামা শাহ কুতুব উদ্দিন (রহ:) মসজিদকেন্দ্রিক সমাজসেবার বিস্তার, ইসলামী শিক্ষা ও দীক্ষার প্রচলন, চক্ষু হাসপাতাল, কারিগরি প্রশিক্ষণ ও সুদমুক্ত ব্যাংকিং সিস্টেম প্রবর্তনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় বায়তুশ শরফ আঞ্জুমানে ইত্তেহাদের সেবাধর্মী কার্যক্রম চালু রয়েছে। এই সংস্থার অধীনে ১৩টি মাদরাসা, ১৬টি এতিমখানা, ১৫টি হিফজখানা, তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৮টি ইসলামী গণপাঠাগার, ৫টি ইসলামী পুস্তক বিপণনকেন্দ্র, তিনটি কার্পেন্ট্রি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ৫টি টেইলারিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ৩টি হেয়ার কাটিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ২টি প্যাকেজিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, একটি ছাপাখানা এবং ৬টি হাসপাতাল ও দাতব্য চিকিৎসালয় পরিচালিত হয়ে আসছে। করোনা পরিস্থিতিতে পার্বত্য রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলার গাঁথাছড়া এলাকায় বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্সের অধীনে হতদরিদ্রদের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়। বর্তমান পীর সাহেব মাওলানা আবদুল হাই নদভী (দা.বা) তত্ত্ব¡াবধানে সেবাকার্যক্রম বিস্তৃতি লাভ করছে।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট আধ্যাত্মিক পুরুষ হজরত মাওলানা শাহ জমিরুদ্দিন নানুপুরী সাহেব (রহ:)-এর হাতে গড়ে ওঠা সেবা সংস্থা আল-মানাহিল ফাউন্ডেশনের জন্ম ১৯৯৮ সালে। মাওলানা হেলালুদ্দীন বিন শাহ জমিরুদ্দিন (রহ:) বর্তমানে আল-মানাহিল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান। তিনি জানান, চট্টগ্রামের মেয়র, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ও সিভিল সার্জনের সহযোগিতায় করোনায় আক্রান্ত অথবা সর্দি-কাশিজনিত উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ৫৫৪ জনকে এই ফাউন্ডেশন স্বাস্থ্যবিধি মেনে গোসল, কাফন ও গ্রামের বাড়িতে লাশ নিয়ে দাফনের ব্যবস্থা করেছে। কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, ফেনী ও সন্দ্বীপের মতো দূরবর্তী এলাকায় মরদেহবাহী ফ্রিজারে করে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয়। মার্চে কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের পর থেকে মেয়র ও মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের সহায়তায় চট্টগ্রাম শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে রিকশাচালক, ভ্যানচালক, পথশিশু, ভিক্ষুক, অন্ধ, পঙ্গু ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের মধ্যে আল-মানাহিল ফাউন্ডেশন ৫০ হাজার প্যাকেট রান্না করা খাবার সরবরাহ করে। ৩৫০ মুমূর্ষু রোগীকে বাড়ি থেকে তুলে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে পৌঁছে দেয়া হয়। আল মানাহিল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে চট্টগ্রামের উত্তর হালিশহর বি-ব্লকে (ফুল চৌধুরী পাড়া) অবস্থিত সাত তলা ভবনে আল মানাহিল নার্চার হাসপাতাল খোলা হয় গত জুলাই মাসে। এক মাসের মধ্যে ৭৫ জন করোনায় আক্রান্ত রোগী ভর্তি হন এবং ৩৯ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। অন্যদের চিকিৎসা চলছে। হাসপাতালে বেড রয়েছে ৫০টি। রোগীদের জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ ও অ্যাম্বুলেন্স সুবিধা। সাতটি হাই-ফ্লো ক্যানোলা দিয়ে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। ঐউট ফ্যাসিলিটিজও রয়েছে। ওঈট ইউনিট এখনো চালু হয়নি। তবে প্রক্রিয়া চলছে। আউটডোর ও ইনডোর চিকিৎসাসেবা ফ্রি। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় প্রতিটি ওয়ার্ডে সাউন্ড সিস্টেমের মাধ্যমে দেড় ঘণ্টা করে পবিত্র কুরআনের তিলাওয়াত পরিবেশিত হয়। এটা রোগীদের থেরাপির কাজ দেয়।
মাওলানা শায়খ আহমদুল্লাহর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় রাজধানীকেন্দ্রিক আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন। শিক্ষা ও দাওয়াতি কর্মসূচির পাশাপাশি রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের সেবাকার্যক্রম। ২০২০ সালে ৪০টি জেলায় ৫৫টি গরু ১৭৬টি ছাগল মোট ৫২৬৪টি দরিদ্র পরিবারে বিতরণ করা হয়। এ বছর দেশজুড়ে ১৩টি জেলায় ৬০৫০টি শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়। ফাউন্ডেশন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রায় ৩ হাজার ৫০০ পরিবারকে ১-৩ হাজার টাকা অর্থসহায়তা করেছে। এ ছাড়া রমজান মাসের খাদ্যসামগ্রী কেনার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ৬০০ রোজাদার পরিবারকে ৩০০০ টাকা করে প্রদান করা হয়েছে। সিএনজি চালকের মধ্য থেকে ৩০০ জন অভাবী চালকের প্রত্যেকের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে ১০০০ টাকা করে। করোনায় বিপদে পড়া আলিম, উবার, পাঠাও, রাইডার, গার্মেন্টকর্মী এবং বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের কাছে ১-৫ হাজার টাকা করে সহায়তা পৌঁছে দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, এ পর্যন্ত সাড়ে ৪ হাজারেরও বেশি পরিবারকে সহায়তা করেছে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন। কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবে অনেক স্বল্প পুঁঁজির মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেছেন। তার মধ্য থেকে ৫০ জন ভাসমান ব্যবসায়ী ও দিনমজুরকে নতুন করে আত্মনির্ভরশীল করার লক্ষ্যে চলতি সপ্তাহে একটি ভ্যান ও নগদ ৫০০০ টাকা করে পুঁজি বিতরণ করেছে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন।
নড়াইলের সাবেক সংসদ সদস্য মাওলানা মুফতি শহিদুল ইসলামের হাতে গড়া সংগঠন আল-মারকাজুল ইসলামী। অ্যাম্বুলেন্স সুবিধা, করোনার লাশ পরিবহন, কাফন-দাফন, গোশত বণ্টন, ত্রাণসামগ্রী বিতরণে রাজধানীসহ গোটা দেশে রেকর্ড তৈরি করেছে। মাওলানা গাজী ইয়াকুবের পরিচালিত তাকওয়া ফাউন্ডেশন বিগত ৬ মাসে ৫০০ লাশ দাফন করেছে। কয়েক হাজার পরিবারে খাবার পৌঁছে দেয়া হয়। নারায়ণগঞ্জের তল্লা মসজিদে এবার গ্যাস বিস্ফোরণে নিহত ৩২ জনের পরিবারকে নগদ অর্থ ও ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়। এই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে একটি দাতব্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ হাতে নেয়া হয়েছে।
মাওলানা মুফতি হাবিবুর রহমান মিসবাহ পরিচালিত ইকরামুল উম্মাহ ফাউন্ডেশন বেশ কয়েকটি প্রজেক্ট নিয়ে এগিয়ে চলেছে। এর মধ্যে জাকাত প্যাকেজ, ইফতার প্যাকেজ, ঈদ প্যাকেজ, গোশত বণ্টন, ত্রাণ বিতরণ, রান্না করা খাবার পরিবেশন ও নগদ অর্থসহায়তা রয়েছে। ১ টাকার অনুদানে ১ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এই টাকার মধ্যে অগ্নিদগ্ধ ৩১ পরিবারের অর্থসহায়তা ও মসজিদ পুনর্নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত। বেদে ও হিজড়াদের পুনর্বাসনের কাজও এই ফাউন্ডেশন করে যাচ্ছে। মাওলানা শায়খ হোসাইন মুহাম্মদ শাহজাহানের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এহইয়াউস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন পবিত্র কুরআনের ১০ লাখ কপি দেশের সর্বত্র বিতরণের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর অনেকের কাছে কুরআন নেই। প্রবল বন্যা ও নদীভাঙনের কারণে বহু মানুষের বাড়িঘর ভেসে গেছে। তিলাওয়াতের জন্য পবিত্র কুরআনের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এহইয়াউস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন এই অভাব পূরণ করবে। মাওলানা তানভির সিরাজের আস-সিরাজ ফাউন্ডেশন কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও চট্টগ্রামের পথশিুদের রান্না করা খাবার, বন্যা উপদ্রুত এলাকায় অগভীর নলকূপ, গৃহনির্মাণসামগ্রী, শুকনো খাবার, চাল, ডাল, তেল বিতরণ করে আসছে।
আলিমদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এ সেবাকার্যক্রম সাধারণ মানুষের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। অর্থোপার্জন, পার্থিব খ্যাতি, যশলিপ্সার মানসিকতা না থাকায় এই সব মানবিক সেবাকার্যক্রমের পরিধি ক্রমে বিস্তৃতি লাভ করছে। মানুষের সেবার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি বিধানই তাদের উদ্দেশ্য। অভিযোগ, মানবসেবার ব্যাপক এই কার্যক্রম মিডিয়ায় যথাযথ কাভারেজ পায় না।
করোনা পজিটিভ রোগী মারা যাওয়ার পর যেখানে স্বজনরা লাশ ফেলে যাচ্ছেন, স্পর্শ করতে ভয় পাচ্ছেন, কাফন-দাফনে এগিয়ে আসছেন না সেখানে আলিম, ইমাম-মাশায়েখ পরিচালিত সেবাসংস্থার স্বেচ্ছাসেবীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লাশ বহন করে নিয়ে গেছেন গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে। গোসল, কাফন-দাফন এবং জানাজার ইমামতিও করেছেন তারা। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, বহু জায়গায় কবরস্থানে স্থানীয় জনগণ লাশ দাফনে বাধার সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে স্থানীয় চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে লাশ দাফনকর্ম সম্পন্ন করতে হয়। রাজধানীর কিছু বুদ্ধিজীবী ইসলাম নিয়ে সংশয় সৃষ্টি করতেন এবং সুযোগ পেলে আলিম-ওলামাদের নিয়ে বিষোদগার করতেও কুণ্ঠিত হতেন না। করোনাভাইরাসে মারা গেলে তাদের লাশ আলিমরাই দাফন করেছেন। আত্মীয় ও আপনজনরা এগিয়ে না আসায় হিন্দু ও খ্রিষ্টানদের লাশও তাদের ধর্মীয় বিধি মোতাবেক আলিমগণ সৎকারের ব্যবস্থা করেন। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নতুন ইতিহাস তৈরি হয়েছে।
ওলামা-মাশায়েখের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এসব সংস্থার প্রতি সাহায্য, সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতার হাত সম্প্রসারিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তাদের মানবিক সেবাকার্যক্রম সদয় বিবেচনায় এনে এনজিও ব্যুরো ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধনপ্রক্রিয়া সহজ করা প্রয়োজন। সরকারি কিছু ত্রাণও এসব সংস্থার মাধ্যমে বিতরণের ব্যবস্থা করলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী উপকৃত হবে। কোনো সংগঠন বা সংস্থার প্রতি মানুষের যদি আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি হয় তাহলে ত্রাণ সহযোগিতার জন্য কারো কাছে ফরিয়াদ করতে হয় না। ত্রাণ রাখার জন্য একাধিক গোডাউন ভাড়া করতে হয়। এমন নজির বাংলাদেশে আছে। এসব কাজে আমানতদারি, জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা সফলতার পূর্বশর্ত। ত্রাণ বিতরণে সঙ্কীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করতে হবে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব ধর্ম, দল ও পেশার মানুষ সমান ট্রিটমেন্ট পাক। অন্যথায় মহান ও মহৎ এই মানবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়ে যাবে।
সেবার ময়দানে আমাদের অতীত ইতিহাস বেশি সুখকর নয়। ১০ বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার মাওলানা আহমদ সাদিক নামক এক সমাজহিতৈষী বাংলাদেশে এসে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পবিত্র কুরআনের তালিম দেয়ার কর্মসূচি হাতে নেন। বিভিন্ন জেলায় কয়েক হাজার নূরানী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। এতে শিক্ষার পাশাপাশি কিছুটা বেকারত্বেরও অবসান ঘটে। কিছুদিন চলার পর একশ্রেণীর কায়েমি স্বার্থবাদী চক্র কলকাঠি নাড়তে শুরু করে। সরকারকে ভুল ঝুঝিয়ে মাওলানা সাদিকের বিরুদ্ধে ‘জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার’ কথিত অভিযোগ আনা হয় এবং তিনি গ্রেফতার হন। অবশেষে মুক্তি পেয়ে শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে তিনি স্বদেশে ফিরে যান দুঃখ ও ক্ষোভ নিয়ে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পবিত্র কুরআনের তালিম দেয়ার একটি সুন্দর প্রকল্প এভাবে বন্ধ হয়ে গেল।
এ ছাড়া বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, রংপুর, দিনাজপুর ও সিলেটের প্রত্যন্ত অনগ্রসর অঞ্চলে কোনো মুসলিম এনজিও সেবাকার্যক্রম চালাতে গেলেই ‘জঙ্গি সম্পৃক্ততা’র অভিযোগ তোলা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। একটি মুসলিম প্রধান দেশে মুসলিম এনজিওদের কাজ করার সুযোগ অবারিত করতে হবে। এ ব্যাপারে আলিম-ওলামা পরিচালিত সেবাসংস্থাগুলো যদি একক প্লাটফর্মে আসতে পারে তাহলে সেবাকার্যক্রম পরিচালনার বাধাগুলো চিহ্নিত করা সহজ হবে এবং রাষ্ট্রের সহায়তায় তা বিদূরিত করা যাবে। তখন রাষ্ট্রের পক্ষে কার্যক্রম মনিটর করাও কঠিন হবে না। মানবিক সেবার আড়ালে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা শোভন নয় এবং কাম্যও নয়। তবে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা তাদের সংগঠনের ব্যানারে ত্রাণতৎপরতা চালাতে বাধা থাকা উচিত নয়। দেশ ও দেশের বাইরে অবস্থানরত ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা এবং সর্বস্তরের সচ্ছল ও হৃদয়বান মানুষ ওলামা-মাশায়েখ পরিচালিত সেবা সংস্থাগুলোর মানবিক কার্যক্রমের প্রতি পরামর্শ ও সহায়তার হাত সম্প্রসারণ করা জরুরি। হ

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ওমর গণি এমইএস ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম

আপনার ইমেইল প্রদর্শন করা হবে না।