সম্প্রীতির মিছিলে বান্দরবান: সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একত্রিত পাহাড়ী জাতিগোষ্ঠী

0

স্টাফ রিপোর্টঃ
বান্দরবান, ২ জানুয়ারি: সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা আর চলমান কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)-এর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বান্দরবান জেলা পরিষদের আয়োজনে বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকার সকল জাতিগোষ্ঠীর স্থানীয় জনগণ একত্রিত হয়ে সম্প্রীতি rally, মানববন্ধন ও পথনাট্য কর্মসূচি পালন করেছে। Rally টি দুপুর ২.০০ টায় জেলা সদরের রাজার মাঠ এলাকা হতে শুরু হয়ে শহর প্রদক্ষ্মীন করে প্রেস ক্লাব এলাকায় এসে শেষ হয়। এরপর মানব বন্ধন কর্মসূচিতে বক্তারা বক্তব্য রাখেন ও সবশেষে নাট্যকর্মীদের পথনাট্য এর মাধ্যমে অনুষ্ঠান শেষ হয়।

স্থানীয়রা জানান, কেএনএফ দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য বান্দরবান এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। তাদের নানাবিধ কার্যক্রম যেমন ব্যাংক ডাকাতি, চাঁদাবাজি, সাধারণ মানুষের উপর হামলা, এবং উন্নয়ন কাজে বাধা সৃষ্টি স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনে অস্থিরতা তৈরি করেছে। নিরপত্তাকে করেছে বিঘ্নিত। যার প্রভাব পড়েছে পর্যটন শিল্প সহ জেলার সামগ্রিক অর্থনীতিতে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় তথা সমগ্র দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের প্রচেষ্টা হিসেবেই এই মানববন্ধনের আয়োজন।

জনমতের ভাষা : মানববন্ধনে অংশ নেওয়া অনেকেই বলেন, কেএনএফ এর কার্যক্রম বন্ধ না হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে। তারা আশা করেন, স্থানীয় প্রশাসন এবং কেন্দ্রীয় সরকার সম্মিলিতভাবে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে নিরাপত্তা বাহিনীকে সহায়তা করবেন।
এই মানববন্ধনের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের আওয়াজ আরও একবার জাতীয় পর্যায়ে পৌঁছাল। আশা করা হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কেএনএফ এর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং এলাকার শান্তি ও উন্নয়ন নিশ্চিত করবে। মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীরা “সন্ত্রাস বন্ধ করো,” “আমরা শান্তি চাই,” এবং “কেএনএফ-কে প্রতিহত করো” লেখা বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড এবং ব্যানার বহন করে ও স্লোগান দেন। কর্মসূচিতে জেলায় বসবাসকারী বাঙালি ও উপজাতিও সকল সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, ছাত্র-ছাত্রী, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেন। মানববন্ধন শেষে আয়োজিত পথসভায় বক্তারা বলেন, “কেএনএফ এর কার্যকলাপ শুধু আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নকেই বাধাগ্রস্ত করছে না, বরং এটি আমাদের সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলাকেও বিপন্ন করছে। আমরা শান্তি চাই, উন্নয়ন চাই, সন্ত্রাস মুক্ত পাহাড় চাই।”
বক্তাদের দাবি, কেএনএফ এর সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধে সরকার যেন সর্বাত্মক ব্যবস্থা হিসেবে সেনাসহ নিরাপত্তা বাহিনীর পর্যাপ্ত মোতায়েন করে ও দ্রুত পর্যটন বান্ধব পরিস্থিতি তৈরী করে। কেএনএফ বম সম্প্রদায়ের কতিপয় বিপথগামী তরুণ তরুণীদের একটি সংগঠন হলেও মানববন্ধনে অংশগ্রহনকারী বম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা ছিলেন কেএনএফ এর বিরুদ্ধে সোচ্চার। তাদের বক্তব্য, সন্ত্রাসী ও অপরাধীরা কখনো কোনো সম্প্রদায়ের অংশ হতে পারে না। বরং কেএনএফ এর কারনে জাতিগত ভাবে তারাই সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী ও অপমানের শিকার। জাতি হিসেব এই লজ্জা থেকে তারা মুক্তি চায়। কেএনএফ এর সাথে মূল বম সম্প্রদায়ের জাতিগতভাবে কোন সম্পৃক্ততা নেই বলে আবারো নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেন তারা।

‘সম্প্রীতির মিছিলে বান্দরবান জেলা’, যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং পর্যটন শিল্পের জন্য বিখ্যাত, কেএনএফ এর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের তা এখন চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।

পর্যটন ব্যবসার ক্ষতি
বান্দরবান জেলা হোটেল-মোটেল ও পরিবহণ মালিক সমিতি জানিয়েছে, জেলায় প্রায় একশ হোটেল, মোটেল এবং রিসোর্ট রয়েছে। পর্যটন মৌসুমে এসব স্থানে প্রতিদিন গড়ে এক কোটি ২০ লাখ টাকার বুকিং হত, এবং সাধারণ মৌসুমে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা বুকিং হতো। বর্তমান অবস্থায় তাদের মাসিক ক্ষতি: প্রতি মাসে ২৪০ কোটি টাকা; বার্ষিক ক্ষতি: বছরে ২,৮৮০ কোটি টাকা।
পাঁচ বছরে ক্ষতি: পাঁচ বছরে ১৪,৪০০ কোটি টাকা।
এই বিশাল আর্থিক ক্ষতির সাথে সাথে পর্যটন খাতের বিপর্যয়ের কারণে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের জীবনযাত্রাও কঠিন হয়ে পড়েছে।

পরিবহণ খাতে ক্ষতি
বান্দরবান জেলা পর্যটন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য পরিচিত, কিন্তু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে পরিবহণ খাতেও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বান্দরবান জেলা পরিবহণ মালিক সমিতি জানিয়েছে, প্রায় সাড়ে ৮০০ যানবাহন রয়েছে, যার মধ্যে বাস, চাঁদের গাড়ি, মাহিন্দ্রা, সিএনজি ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত।
মৌসুমে দৈনিক ক্ষতি: ২৫ লাখ টাকা।
মাসিক ক্ষতি: ৭৫ কোটি টাকা।
বার্ষিক ক্ষতি: ৯০০ কোটি টাকা।
পাঁচ বছরে ক্ষতি: ৪,৫০০ কোটি টাকা।
এই ক্ষতির কারণে পরিবহণ খাতে নেমে এসেছে একটি গভীর সংকট, যার ফলে সাধারণ মানুষ এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অস্ত্র লুটের ঘটনা
কেএনএফ-এর সন্ত্রাসী হামলা শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্যও বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশের এবং আনসারের অস্ত্র লুট হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, যা জনগণের নিরাপত্তাকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে। লুট হওয়া অস্ত্রের পরিমাণ:
পুলিশের অস্ত্র লুট:
২টি এসএমজি, ৩০ রাউন্ড গুলি।
৮টি চায়না রাইফেল, ৩২০ রাউন্ড গুলি।
আনসারের অস্ত্র লুট:
৪টি শর্টগান, ৩৫ রাউন্ড গুলি।
এই অস্ত্র লুটের ফলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।

মানববন্ধনের বার্তা: সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শান্তির আহ্বান
আজকের মানববন্ধনে স্থানীয় জনগণ একত্রিত হয়ে কেএনএফ-এর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে সরকারের কাছে জরুরি পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছে। তারা বিশ্বাস করেন, যদি সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একযোগভাবে কাজ করে, তবে এ ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধ করা সম্ভব হবে। বান্দরবানের জনগণ তাদের শান্তিপূর্ণ ও উন্নয়নমুখী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কেবল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নয়, বরং ন্যায়ের জন্যও তাদের দাবি জানান। এই আন্দোলন শান্তি প্রতিষ্ঠার দিকে একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে, যা দেশের অন্যান্য অঞ্চলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধে প্রভাব ফেলতে পারে।

বান্দরবানের জনগণের এই মানববন্ধন কেবলমাত্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নয়, বরং সমগ্র দেশের জন্য এক শক্তিশালী বার্তা। এর মাধ্যমে তারা প্রমাণ করেছেন যে, একত্রিত হলে কোনো শক্তি তাদেরকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বাধা দিতে পারবে না। এটি একটি নতুন দিশার শুরু, যেখানে শান্তি, সম্প্রীতি, এবং উন্নতির পথে হাঁটতে হবে সবাইকে।

আপনার ইমেইল প্রদর্শন করা হবে না।