লড়াইটা আসলে মেসি-নেইমারের কৃতিত্বের মান নিয়ে

৭৭

ব্রাজিল–আর্জেন্টিনা ফাইনালে লিওনেল মেসির মুখোমুখি হবেন নেইমার।ব্রাজিল–আর্জেন্টিনা ফাইনালে লিওনেল মেসির মুখোমুখি হবেন নেইমার। লড়াইটা আসলে মেসি-নেইমারের

আর্জেন্টিনা ফাইনালে ওঠার পর চারদিকে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এবারের কোপা আমেরিকার ফাইনালটা যে হচ্ছে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা। বাংলাদেশে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ম্যাচের মাহাত্ম্য একটু অন্য রকমই।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সেই রামও নেই, নেই সেই অযোধ্যাও। লাতিন ফুটবলে একটা সময় ছন্দ ছিল। প্রায় প্রতিটা দলেই ছিল তারকার ছড়াছড়ি, ছিল ব্যক্তি নৈপুণ্যের ঝলক। একটা সময় ব্রাজিল দলে পেলের পাশে খেলেছেন গারিঞ্চা, ভাভা, দিদির মতো ফুটবলার। আরও পরের কথা বললে ব্রাজিলের হলুদ জার্সিতে রোমারিও, রিভালদো, রোনালদো, রোনালদিনিওরা খেলেছে।

আর্জেন্টিনা দলে ডিয়েগো ম্যারাডোনার সতীর্থ ছিলেন ক্যানিজিয়া-বাতিস্তুতারা। পরের দিকে দলটিতে একসঙ্গে খেলেছে রিকেলমে-ক্রেসপো-স্যাভিওলারা। সেই তুলনায় ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা দলে এখন তারকা কোথায়? এখন আর্জেন্টিনার আছে শুধু লিওনেল মেসি, ব্রাজিলের সবেধন নীলমণি নেইমার। সেদিক থেকে এবারের আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ফাইনালের ম্যাচটা আসলে মেসি আর নেইমারের লড়াই।

অনেকেই বলতে পারেন, তাহলে কী আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলে মেসি বা নেইমার ছাড়া আর কেউ খেলছে না! হ্যাঁ, নিশ্চয়ই খেলছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমি পাল্টা প্রশ্ন করব—এমন একজনের কথা বলুন, যে বিশেষ করে নজর কেড়েছে।

আর্জেন্টিনা দলে মেসিকে সাহায্য করার জন্য যারা আছে তাদের মধ্যে বেশি পরিচিত মুখ বলতে লাওতারো মার্তিনেজ, সের্হিও আগুয়েরো, আনহেল দি মারিয়া। এই তিনজনের মধ্যে আগুয়েরো আর দি মারিয়া এখন আর শুরুর একাদশে নিয়মিত নয়। মার্তিনেজ ইন্টার মিলানে দুর্দান্ত একটি মৌসুম কাটিয়ে কোপা আমেরিকায় খেলতে এসেছে, এখন পর্যন্ত তিনটি গোলও করেছে সে। কিন্তু আলাদা করে তাকে মানুষ মনে রাখবে, এমন কিছু করতে পারেনি। অন্তত আমার চোখে পড়েনি।

কলকাতায় মেসির পোস্টার হাতে দুই ভক্ত।কলকাতায় মেসির পোস্টার হাতে দুই ভক্ত।
তবে হ্যাঁ, দি মারিয়া কলম্বিয়ার বিপক্ষে সেমিফাইনালে বদলি হিসেবে নেমে দু-একবার ঝলক দেখিয়েছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ম্যাচে পার্থক্য গড়ে দেওয়ার কাজটি সেই মেসিই করেছে। তার দুর্দান্ত একটি মুভ আর পাস থেকেই মার্তিনেজ আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে দেওয়া গোলটি করেছে।

মাঝমাঠের অবস্থাও সেই একই রকম। রদ্রি দি পল, গিদো রদ্রিগেজ, জিওভান্নি লো সেলসো, লিওনার্দো পারেদেসদের সমন্বয়ে গড়া মাঝমাঠ সেভাবে আলো ছড়াতে পারছে না। মাঝমাঠ থেকে মেসিকে বল সরবারহ করার কাজটি করতে হবে তাদেরই। সেই কাজটাও তারা ঠিকঠাক করতে পারছে বলে আমার মনে হয় না।

তাই তো মেসিকে খেলা তৈরি করতে প্রায়ই অনেক নিচে নেমে আসতে হচ্ছে। এভাবে নিচে নেমে খেলা তৈরি করতে গেলে প্রতিপক্ষের রক্ষণ পর্যন্ত যেতে তাকে লম্বা পথ পাড়ি দিতে হয়। ফলে বল হারানোর সম্ভাবনা থেকে যায়। এ কারণেই প্রতিপক্ষের বক্সের সামনে মেসির আতঙ্ক ছড়ানো মুভও কমে যাচ্ছে।

আর্জেন্টিনার অনুশীলনে লিওনেল মেসি।আর্জেন্টিনার অনুশীলনে লিওনেল মেসি।
এবার যদি ব্রাজিলের দিকে তাকাই, দলটি ফাইনালে উঠেছে এক নেইমারের কাঁধে ভর করেই। মাত্র দুটি গোল করলেও ব্রাজিলের বেশির ভাগ গোলে তার অবদান। নেইমার যে দলকে কীভাবে টানছে সেটা স্পষ্ট হয়েছে গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচটিতে। ইকুয়েডরের বিপক্ষে সেই ম্যাচে কোচ তিতে তাকে বিশ্রাম দিয়েছিলেন। নেইমারকে ছাড়া খেলা সেই ম্যাচটি জিততে পারেনি ব্রাজিল। ফাইনালে আক্রমণে নেইমারকে সাহায্য করার জন্য যারা আছে তাদের কেউ হয়তো ছন্দে নেই, কেউ আবার মাঠে শুধুই অনর্থক ছোটাছুটি করছে।

রবার্তো ফিরমিনো লিভারপুলের মতো ক্লাবে খেলে, কিন্তু ছন্দে নেই বলে তার প্রতি কোচ খুব একটা আস্থা রাখতে পারছেন না। তাই তো শুরুর একাদশে জায়গা হচ্ছে না তার। খুব বাজে একটা ফাউল করে কোয়ার্টার ফাইনালে লাল কার্ড দেখা গ্যাব্রিয়েল জেসুসের তো ফাইনালে খেলাই হবে না। ফরোয়ার্ডে নেইমারের সঙ্গে বড় ভূমিকা নিতে হচ্ছে লুকাস পাকেতাকে। এটা ঠিক যে টুর্নামেন্টে দুটি গুরুত্বপূর্ণ গোল করেছে সে, কিন্তু দুটি গোলই এসেছে থালায় সাজিয়ে দেওয়ার মতো পাস থেকে।

একজন খেলোয়াড় ছাড়া দুই দলের স্কোয়াডের অবস্থাই যখন তথৈবচ, আমি এর মধ্যেও এগিয়ে রাখব আর্জেন্টিনাকে। ব্রাজিলের চেয়ে তাদের খেলোয়াড়দের মাঠে ছোটাছুটিটা অন্তত একটু বেশি। নিজের কাজটা ঠিকঠাকভাবে করতে না পারলেও ব্রাজিলের বেশির ভাগ খেলোয়াড়েরই মাঠে দেখানদারি ফুটবল খেলার একটা প্রবণতা আছে।

এটা করতে গিয়ে তারা নিজেদের আর প্রতিপক্ষের অর্ধে খুব বেশি বল হারাচ্ছে। আর্জেন্টিনা দলের ক্ষেত্রে এমনটা হচ্ছে না। এ ছাড়া এবার ব্রাজিলের চেয়ে আর্জেন্টিনার রক্ষণটাকেও একটু বেশি দৃঢ় মনে হচ্ছে আমার কাছে। এটা ঠিক যে নাম বিবেচনায় ব্রাজিলের রক্ষণই এগিয়ে। কিন্তু থিয়াগো সিলভার বয়স বেড়েছে, আগের মতো সেই রিফ্লেক্স নেই।

ব্রাজিলের অনুশীলনে নেইমার।ব্রাজিলের অনুশীলনে নেইমার।
মার্কিনিওসও পিএসজিতে তার আঁটসাঁট ভাবটা দেখাতে পারছে না। দানিলোকে দেখেও আমার মনে হচ্ছে না সে খুব একটা ছন্দে আছে। আর ব্রাজিল দলে থাকা দুই গোলকিপার আলিসন ও এদেরসন সময়ের অন্যতম সেরা। কিন্তু কোপা আমেরিকায় ব্রাজিলের গোলবারের নিচে আলিসনকে খুব একটা জমাট মনে হয়নি আমার কাছে। যদিও সে টুর্নামেন্টে মাত্র দুটি গোলই খেয়েছে, কিন্তু তার কিছু অস্বস্তিকর মুহূর্তও দেখেছি আমি। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ফুটবলে আর্জেন্টিনার গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্তিনেজ গত মাসেই এলেও তাকে বেশ তৈরি বলেই মনে হয়েছে। আর সেমিফাইনালে কলম্বিয়ার বিপক্ষে টাইব্রেকারে তিনটি শট ঠেকিয়ে দেওয়ার পর তো সে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠারই কথা।

দলীয় হিসাব থেকে বেরিয়ে এবার মেসি আর নেইমারের দ্বৈরথের কথা বলা যাক। সময়ের অন্যতম সেরা দুই খেলোয়াড়ের দ্বৈরথে আমি এবারের ফাইনালে নেইমারকেই এগিয়ে রাখব। তবে এটা ফুটবলীয় দিক থেকে নয়। এ নিয়ে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয় যে মেসি ও নেইমার দুজনই অসাধারণ খেলোয়াড়। আর এখন পর্যন্ত ক্লাব ফুটবলে মেসির যা অর্জন তার কাছেপিঠেও নেই নেইমার। তাহলে নেইমারকে কেন এগিয়ে রাখা?

তার চাপ জয় করার সামর্থ্য অনেক বেশি অথবা চাপ সে নেয়ই না। নেইমারের খেলা একটু ভালো করে লক্ষ করলে এটা সবারই চোখে পড়বে যে সে মনের আনন্দে খেলে। গোল পেল কি পেল না, শিরোপা জিতল কি জিতল না; এতে যেন তার কিছুই এসে যায় না! এটা কেন, সেটা এত দূর থেকে বলা মুশকিল। তবে আমার কাছে মনে হয় ওর মধ্যে এখনো শিশুসুলভ একটা ভাব আছে। এর জন্যই হয়তো ওর কাছে খেলা শুধুই খেলা!

অন্যদিকে মেসি খুব বেশি চাপ নিয়ে ফেলে। তার খেলায়ও এর ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। ২০১৪ বিশ্বকাপের পর ২০১৫ ও ২০১৬ সালের কোপা আমেরিকা যদি কেউ মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করে থাকে তাহলেই এটা বুঝতে পারবে। খুব ভালো খেলে দলকে নিয়ে ওই তিন টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠেছে মেসি।

কিন্তু তিনটি ফাইনালেই সে অনেকটাই নিষ্প্রভ ছিল, কিছুই যেন ঠিকঠাক হচ্ছিল না তার। একটু যেন আড়ষ্টও ছিল সে। এর কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমার কাছে মনে হয়েছে আর্জেন্টিনার লম্বা সময়ের শিরোপা-খরা আর তার নিজের জাতীয় দলের এখনো কিছু জিততে না পারার চাপ ফাইনালে তাকে পেয়ে বসে। আর এসব নিয়ে তো কম কথাও শুনতে হয়নি মেসিকে!

ব্রাজিল–আর্জেন্টিনা ফাইনালের আবেদন বিশ্বব্যাপী। ফাইনালের আগে কলকাতায় আর্জেন্টিনার পতাকা ও খেলোয়াড়দের পোস্টার।ব্রাজিল–আর্জেন্টিনা ফাইনালের আবেদন বিশ্বব্যাপী। ফাইনালের আগে কলকাতায় আর্জেন্টিনার পতাকা ও খেলোয়াড়দের পোস্টার।
তা ছাড়া যখনই যিনি আর্জেন্টিনার কোচ হয়ে এসেছেন, মেসির চাপ আরও বাড়িয়ে দেওয়ার মতো কাজই করেছেন। আর্জেন্টিনার বর্তমান কোচ লিওনেল স্কালোনির কথাই ধরা যাক, বারবার তিনি দলের খেলোয়াড়দের বলছেন—তোমরা মেসির জন্য খেল। মেসির সতীর্থরাও সবাই সেই আপ্তবাক্য আওড়ে যাচ্ছে—আমরা মেসির জন্য খেলি।

এমনটা বলতে বলতে মেসির চাপের বোঝাটা সবাই মিলে পাহাড়প্রমাণ করে তুলেছে। পিঠের থেকে এই চাপের বোঝাটা নামিয়ে ফাইনাল খেলতে নামলে ব্রাজিলের বিপক্ষে হয়তো প্রাণবন্ত এক মেসিকেই দেখা যাবে। যেমনটা ব্রাজিলের প্রায় প্রতিটা ম্যাচেই দেখা যায় নেইমারকে।

লেখক: সাবেক ফুটবলার, কোচ ও ফুটবল বিশ্লেষক

মন্তব্য বন্ধ আছে তবে ট্র্যাকব্যাক ও পিংব্যাক চালু রয়েছে।