পার্বত্য অঞ্চল থেকে ২০ বছরে ১১৯টি সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার হয়েছে
আলোকিত লংগদু ডেক্সঃ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় পার্বত্য অঞ্চল থেকে অনেক অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। চুক্তি স্বাক্ষরকালীন ২৩২টি অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প থেকে গত ২০ বছরে ১১৯টি ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। বাকিগুলোও কয়েকটি ধাপে প্রত্যাহার করা হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৮১ সালে দেশে ফিরে এসে আমি ঘোষণা দিয়েছিলাম যে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা রাজনৈতিক সমস্যা, সামরিক শক্তি দিয়ে নয়, রাজনৈতিকভাবে এর সমাধান করতে হবে।’
জাতীয় সংসদে গতকাল বুধবার নির্ধারিত প্রশ্নোত্তরকালে রাঙামাটির স্বতন্ত্র সাংসদ ঊষাতন তালুকদারের তারকাচিহ্নিত প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। তিনি চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি এবং ওই এলাকার উন্নয়ন সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, শান্তি চুক্তির আলোকে মোতায়েনরত সেনাবাহিনীর সব অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ছয়টি গ্যারিসন দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবান, রুমা ও আলীকদমে প্রত্যাবর্তনের বিধান রয়েছে। এ লক্ষ্যে গ্যারিসনসমূহের প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন চলমান রয়েছে। রুমা গ্যারিসনের ৯৯৭ একর ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন। গ্যারিসনসমূহের অবকাঠামোগত উন্নয়ন সম্পন্ন করে সময়োচিতভাবে অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের মাধ্যমে মোতায়েনরত সেনাবাহিনীকে নির্দিষ্ট গ্যারিসনসমূহে প্রত্যাবর্তনের পরিকল্পনা রয়েছে।
৭২টির মধ্যে ৪৮টি সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন: শেখ হাসিনা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে। আর নয়টি ধারা বাস্তবায়নাধীন আছে। এখনো যেসব ধারা বাস্তবায়ন হয়নি, সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। তিনি বলেন, চুক্তি বাস্তবায়ন ও মনিটরিং করার জন্য সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে এই অঞ্চলের জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, আর্থসামাজিক উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য পরপর পাঁচটি ভূমি কমিশন গঠন করা হয়েছে। ভূমি সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১ পাস করা হয়েছে। এই কমিশন সম্পর্কে আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক উত্থাপিত আপত্তিসমূহ বিবেচনা করে ওই আইনের সংশোধনী প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন আছে।
চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘পার্বত্যবাসী আমাদের দেশেরই নাগরিক, সুখ-দুঃখের সাথি। তাদের যদি কোনো দুঃখ থাকে, তা নিরসনের দায়িত্ব আমাদেরই।’ এই চুক্তির ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো কোনো বিদেশি শক্তিকে সম্পৃক্ত না করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘তাদের (পার্বত্যবাসী) ভালোমন্দ যদি আমরা না বুঝি, বাইরের কেউ বুঝবে না।’
ভূমিবিষয়ক ক্ষমতা জেলা পরিষদে হস্তান্তর না করা-সংক্রান্ত ঊষাতন তালুকদারের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভূমি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব জেলা পরিষদকে দেওয়া হলে তা ধারণ করার সক্ষমতা তাদের অর্জন করতে হবে। এ জন্য জেলা পরিষদকে শক্তিশালী করা হচ্ছে। আমরা সকলকে নিয়েই এ অঞ্চলে কাজ করতে চাই।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সব সময় বলেছি, সমাধান হবে সংবিধানের আওতায়। যখন চুক্তি হয়, বিএনপি-জামায়াত তার বিরোধিতা করেছিল। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন, এই চুক্তি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের ফেনী পর্যন্ত ভারত হয়ে যাবে। উনি তখন ফেনীর সংসদ সদস্য, তাই উনাকে প্রশ্ন করেছিলাম, ফেনী যদি ভারত হয়ে যায়, তাহলে কি উনি ভারতের সংসদে গিয়ে বসবেন?’ তিনি বলেন, যেদিন অস্ত্র সমর্পণ হয়, সেদিন বিএনপি পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় হরতাল-অবরোধ ডেকেছিল, যাতে অস্ত্র সমর্পণ না হয়। এই ১০ ফেব্রুয়ারি কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্ত্র জমা দেন বিদ্রোহীরা।
১২ হাজার শরণার্থী পরিবার পুনর্বাসন: প্রধানমন্ত্রী বলেন, চুক্তি বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় ভারত প্রত্যাগত ১২ হাজার ২২৩টি শরণার্থী পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। প্রতিটি পরিবারকে ৫০ হাজার নগদ টাকা দেওয়া হয়েছে। ২০ বছর আগে যাঁরা চাকরিস্থান ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন, তাঁদের পুনরায় চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিধিমালা শিথিল করে পার্বত্যবাসীদের পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীতে চাকরি দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘শান্তি চুক্তি যখন করেছি, কাজেই চুক্তির ধারাগুলো আমরা বাস্তবায়ন করব। আমরা আরও আগেই বাস্তবায়ন করতে পারতাম, কিন্তু হাতে সময় ছিল না। যে ধারাগুলো এখনো বাস্তবায়িত হয়নি, সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নে আমরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি।’
সরকারদলীয় সাংসদ শামসুল হক চৌধুরীর এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে বিমানবন্দর করতে হলে পাহাড় কেটে করতে হবে। সেটা পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য ভালো হবে না। আমরা রাস্তা করে দিচ্ছি। কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বেশি দূরে নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য রাস্তা দিয়ে চলাই ভালো হবে।’ ইতিমধ্যে ২১৭ কিলোমিটারব্যাপী ৩৫টি নতুন বিওপি স্থাপন করা হয়েছে। আরও ১৭টি বিওপি স্থাপন প্রক্রিয়াধীন আছে। যাতে ৯০ কিলোমিটার অরক্ষিত সীমান্ত নিরাপত্তার আওতায় আসবে। আশা করা যায়, বর্তমান শুষ্ক মৌসুমের পর ১৩৬ কিলোমিটার অরক্ষিত সীমান্ত অবশিষ্ট থাকবে, যা আগামী শুষ্ক মৌসুমের মধ্যে নিরাপত্তার আওতায় আনা সম্ভব হবে। তাতে পার্বত্যচট্টগ্রাম ও হবে একটি নতুন মাত্রার পযর্টন কেন্দ্র।