পাকুয়াখালী এক শোকবহ ট্রাজেডি! দুইযুগে ও বিচার পায়নি বাঙ্গালী পরিবাররা, অসহায় দিন গুনছে অনেক পরিবার
এম এ আমিন
পাকুয়াখালী গণহত্যার শোকাবহ স্মৃতি সম্বলিত দিন- ৯ সেপ্টেম্বর, পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের এক ভয়ংকর কালোদিন । ১৯৯৬ সালের এই দিনে রাংগামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার পাকুয়াখালীতে পাহাড়ে কাঠ কাটতে যাওয়া ৩৫ জন নিরীহ বাঙালী কাঠুরিয়াকে নির্মম নির্যাতন আর অত্যাচার করে । শ্রমই ছিলো তাদের জীবিকা নির্বাহের উপায়। রুজি- রোজগারের সহজ বিকল্প কোন উপায় না থাকায় বনের গাছ, বাঁশ আহরণেই তারা বাধ্য ছিলো। মাধ্যমে হত্যা করেছিল সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন তথাকথিত শান্তিবাহিনীরা । পার্বত্যাঞ্চলে শান্তিবাহিনীরা এর আগেও অসংখ্য গনহত্যা করেছিল কিন্তু এই হত্যাকান্ড সকল বর্বরতা আর নৃসংশতাকে হার মানিয়েছিল । কারণ এতগুলো মানব সন্তানকে হত্যা করতে ঘাতকরা একটি বুলেটও খরচ করেনি, শুধুমাত্র দেশীয় অস্রের আঘাতে হিংস্র হায়েনার মতো ক্ষত বিকৃত করেছিল প্রতিটি লাশ । তাই উদ্ধার করার সময় অধিকাংশ লাশেরই পরিচয় সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি ।
বনই হলো সন্ত্রাসী শান্তিবাহিনীর আখড়া। জীবিকার তাগিদে ঐ হিংস্র সন্ত্রাসীদের সাথে শ্রমিকরা গোপন সমঝোতা গড়ে তুলতে বাধ্য হয়। তারা সন্ত্রাসীদের নিয়মিত চাঁদা ও আহরিত গাছ, বাঁশের জন্য মোটা অংকের সালামী দিতো। অনেক সময় মজুরীর বিনিময়ে শান্তিবাহিনীর পক্ষেও গাছ, বাঁশ কাটতো, এবং তা খরিদ বিক্রির কাজে মধ্যস্ততা করতো। ব্যবসায়ীরাও তাদের মাধ্যমে শান্তিবাহিনীর সাথে যোগাযোগ ও লেনদেন সমাধা করতো। জীবিকার স্বার্থে তারা ছিলো রাজনীতিমুক্ত অসাম্প্রদায়িক শ্রমিক মাত্র।
শান্তিবাহিনীর রেশন, ঔষধ, পণ্য ও লেনদেন সংক্রান্ত যোগাযোগ ও আদান-প্রদান এদের মাধ্যমেই পরিচালিত হতো। ঐ বাহিনীর অনেক গোপন ক্যাম্পে তাদের প্রয়োজনে আনাগোনা এবং ওদের কোন কোন সদস্যের ও শ্রমিক ঠিকানায় যাতায়াত ছিলো। এই যোগাযোগের গোপনীয়তা উভয়পক্ষ থেকেই বিশ্বস্ততার সাথে পালন করা হতো। উভয় পক্ষই প্রয়োজন বশতঃ পরস্পরের প্রতি ছিলো বিশ্বস্ত ও আস্থাশীল। এরূপ আন্তরিক সম্পর্কের কারণে পরস্পরের মাঝে বৈঠক ও যোগাযোগ নিঃসন্দেহে ও স্বাভাবিকভাবে ঘটতো। এ হেতু ৯ সেপ্টেম্বরের আগে মাহাল্যা অঞ্চলের নিকটবর্তী পাকুয়াখালি এলাকায় শান্তিবাহিনীর সাথে বৈঠকের জন্য নিহত ব্যক্তিদের ডাকা হয়। আহুত ব্যক্তিরা নিঃসন্দেহেই তাতে সাড়া দেয় এবং বৈঠকস্থলে গিয়ে পৌঁছে।
ঘটনাস্থল পাকুয়াখালি হলো, মাহাল্যাবন বীটভুক্ত বেশ কিছু ভিতরে পূর্বদিকে গহীন বন ও পাহাড়ের ভিতর জনমানবহীন অঞ্চল। মাহাল্যাসহ এতদাঞ্চল হলো উত্তরের বাঘাইছড়ি থানা এলাকা। আহুত লোকজন হলো দক্ষিণের ও নিকটবর্তী লংগদু থানা এলাকার বাসিন্দা। তাদের কিছু লোক হলো আদি স্থানীয় বাঙ্গালী আর অবশিষ্টরা হাল আমলের বসতি স্থাপনকারী। এই সময়কালটাও ছিলো শান্ত নিরূপদ্রব। স্থানীয়ভাবে কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও বিরোধ নিয়ে তখন কোন উত্তাপ উত্তেজনা ছিল না। এমন শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিতে প্রতিশোধমূলক ও হিংসাত্মক কোন দুর্ঘটনা ঘটার কার্যকারণ ছিলো অনুপস্থিত।
পার্বত্য চট্টগ্রামে দাঙ্গা-হাঙ্গামা চাঁদাবাজি ছিনতাই অগ্নিসংযোগ হত্যা উৎপীড়ন অহরহই ঘটে। তার কার্যকারণও থাকে। রাজনৈতিক উত্তাপ-উত্তেজনা ছাড়াও স্বার্থগত রেষারেষি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ইত্যাদি জাতিগত প্রতিশোধ পরায়ণতাকে সহিংসতার কারণ রূপে ভাবা যায়। কিন্তু আলোচ্য সময়টিতে অনুরূপ পরিবেশ ছিলো না। তাই সম্পূর্ণ অভাবিতভাবে নৃশংস ঘটনাটি ঘটে যায়। খবর পাওয়া গেলোঃ বৈঠকের জন্য উপস্থিত শ্রমিকদের একজন বাদে অপর কেউ জীবিত নেই, নৃশংসভাবে নিহত হয়েছে। হাহাকারে ছেয়ে গেলো গোটা এলাকা। তাদের খোঁজে সেনা, পুলিশ, বিডিআর, আনসার ও পাবলিকদের যৌথ তল্লাসী অভিযানে পাকুয়াখালির পাহাড় খাদে পাওয়া গেলো ২৮টি বিকৃত লাশ। বাকিরা চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে। এখনো তাদের সন্ধান মিলেনি। পালিয়ে প্রাণে বাঁচা একজনই মাত্র আছে যে এই গণহত্যা খবরের সূত্র।
এটি কার্যকারণহীন নির্মম গণহত্যা। এটি মানবতার বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত নৃশংস অপরাধ। ন্যায় বিচার ও মানবতা হলো বিশ্ব সভ্যতার স্তম্ভ। জাতিসংঘ এ নীতিগুলো পালন করে। তাই তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জার্মানদের হাতে গণহত্যার শিকার ইহুদীদের পক্ষে এখনো বিচার অনুষ্ঠিত হয়। এখনো ঘোষিত অপরাধীদের পাকড়াও করা হয়ে থাকে। অধুনা যুগোস্লাভিয়ায় অনুষ্ঠিত গৃহযুদ্ধে গণহত্যার নায়কদের পাকড়াও, বিচার অনুষ্ঠান ও শাস্তি বিধানের প্রক্রিয়া চলছে। কম্বডিয়ায় অনুষ্ঠিত পলপট বাহিনীর গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়াটিও জাতিসংঘ ও কম্বডিয়া সরকারের প্রক্রিয়াধীন আছে। এই বিচার তালিকায় পাকুয়াখালি, ভূষণছড়া ইত্যাদি গণহত্যাগুলো অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য। সভ্য জগতে উদাহরণ স্থাপিত হওয়া দরকার যে, মানবতার বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত প্রতিটি অপরাধ অবশ্যই বিচার্য। সংশ্লিষ্ট দেশ ও জাতি তা অবহেলা করলেও জাতিসংঘ তৎপ্রতি অবিচল।
স্বাধীনতা, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার দাবী-দাওয়ার পক্ষে, পরিচালিত রাজনীতি, আন্দোলন ও সশস্ত্র তৎপরতায়, নির্বিচারে গণহত্যা কোন মতেই অনুমোদন যোগ্য নয়। এখন স্বাভাবিক শান্ত পরিবেশে গণহত্যার অভিযোগগুলো যাচাই করে দেখা দরকার। পার্বত্য চট্টগ্রামে এরূপ বিচারযোগ্য ঘটনা অনেকই আছে ও তার বিচার অবশ্যই হতে হবে। সাধারণ ক্ষমার আওতা থেকে গণহত্যার অপরাধটি অবশ্যই বাদ যাবে।
সন্তু বাবু এখন সরকারের নিরাপদ পক্ষপুটে আশ্রিত। তাই বলে তাকে অভিযুক্ত করা যাবে না, এমন পক্ষপাতিত্ব ন্যায় বিচারের বিরোধী। সন্তু বাবু নিজেকে নিরপরাধ মনে করলে, সরকারের পক্ষপুট ছেড়ে বিচার প্রক্রিয়ার কাছে নিজেকে সোপর্দ করুন। নিরপরাধ স্বজাতি হত্যার অনেক অভিযোগও তার বিরুদ্ধে ঝুলে আছে। অধিকার আদায়ের সংগ্রাম মানে তো, মানুষ হত্যার অবাধ লাইসেন্স লাভ নয়। মানবতাবাদী সংগঠনের হিসাব মতে, তাদের হাতে অন্ততঃ ত্রিশ হাজার স্থানীয় অধিবাসীর প্রাণনাশ ঘটেছে। এটি গুরুতর অভিযোগ।
ঐ ঘটনার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসা ইউনুছ আলীর চোখে এখনো ভেসে ওঠে খুনীদের বিভত্স চেহেরা আর মৃত্যুপথ যাত্রি কাঠুরিয়াদের বিদায়ী মরণ আর্তনাদ । সেদিন পাকুয়াখালীর পাহাড়ি ছড়া দিয়ে পানির পরিবর্তে প্রবাহিত হয়েছিল বাঙালী ভাইদের রক্ত । রঙ্গিন হয়েছিল কাচালং আর মাইনীর খাল । লংগদুর আকাশ বাতাস ভারি হয়েছিল অসহায় বাঙালিদের করুণ কান্নার আহাযারিতে । খুব কাছ থেকেই অনুভব করেছিলাম সেদিনের মর্মস্পশী মূহুর্তগুলো । স্বচক্ষে দেখেছিলাম বাঙালী ভাইদের ছিন্নবিচ্ছিন্ন , ক্ষত বিক্ষত নিষ্প্রাণ দেহগুলো । নিজের কানে শুনেছিলাম স্বামিহারা বোনের আর ছেলেহারা মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ । সে কথা আজো মনে হলে ক্ষোভে আর ঘৃনায় মনটা বিষিয়ে ওঠে । স্হানিয় বাঙালীরা নিহতদের জন্য চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি সেদিন ।
এই নারকীয় গনহত্যার পর বর্তমান ক্ষমতাশীন দলের তত্কালীন চারজন প্রভাবশালী মন্ত্রী লংগদু উপজেলা পরিষদ মাঠে বিক্ষুদ্ধ জনতার সামনে উপস্হিত হয়ে এই হত্যাকান্ডের বিচারের প্রতিশ্রতি দিয়েছিলেন । নিহতের পরিবারদের আর্থিক ক্ষতিপূরনের এবং শহিদদের ছেলে সন্তানদের সরকারীভাবে কর্ম সংস্হানের ব্যবস্হা করে দেওয়ার ঘোষনা দিয়েছিলেন । কিন্তু ঘটনার দেড় যুগ পার হলেও কোন কিছুই করা হয়নি শহিদ পরিবারদের জন্য । পরিবারের উপার্জনক্ষমকে হারিয়ে আজো নিহতদের অসহায় স্রী আর সন্তানেরা পথে পথে ঘুরছে দুমোঠো অন্নের জন্য । আজো তারা জানেনা কি ছিল তাদের অপরাধ ?
ঘটনার পর লংগদু থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হলেও ২৪ বছর পার হলেও রহস্যজনক কারণে এখনো পর্যন্ত কোন আসামীকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ । ঘটনা তদন্তের জন্য সরকারীভাবে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও আজো তাদের তদন্ত করা শেষ হয়নি । এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে গেলে উপজেলার কালাপাকুজ্যা গ্রামের নিহত ওসমান আলীর মা কান্নাজড়িত কন্ঠে জানান, একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে তারা এখন পথের ভিখারি । অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটে তার অসহায় সন্তানদের । এখনো পথ চেয়ে বসে আছে রসুলপুর গ্রামের নিহত আলী হোসেনের পরিবার । হত্যাকান্ডের পর আলী হোসেনের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি তাই ওদের বিশ্বাস তাদের ছেলে কোন একদিন ফিরে আসবেই । অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়ে শোকাহত হৃদয়ে জীবনের সাথে কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত আছেন অপর এক গ্রাম মোহাম্মদপুরের হেলাল উদ্দিনের স্রী নুরবানু ।কিভাবে চলছে তার জীবন- জানতে চাইলে কেঁদে দুচোখ ভাসিয়ে তিনি জানালেন, কম বয়সে স্বামীকে হারিয়ে দুটি সন্তানকে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে কেটেছে তার জীবন । “আমার স্বামীরে বিনা দোষে যারা খুন করছে তাদের বুকের উপর আল্লার গজব পড়ুক”- এভাবেই তিনি খুনীদের প্রতি অভিশাপ দেন । সরকারীভাবে কত টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন– জানতে চাইলে তিনি জানান, খুন হওয়ার কয়েকদিন পর শুধুমাত্র ৫০ হাজার টাকা ছাড়া আর তেমন কিছুই পায়নি তারা । তার স্বামীর খুনিদের বিচার দাবি করেছেন তিনি ।