ঘুষ ছাড়া ফাইল ধরেন না বাঘাইছড়ি একাউন্ট অফিসার পেয়ার মোহাম্মদ

২২২

ওমর ফারুক সুমন বাঘাইছড়ি:

টাকা ছাড়া কোনো ফাইলে হাত দেন না। খাতা কলমে হিসাব কষে পার্সেন্ট ধরে ঘুষ আদায় করেন। ঘুষের টাকার হিসাব রাখতে বানিয়েছেন আলাদা রেজিস্ট্রার খাতা। কথা মত ঘুষ না দিলে ফাইল আটকে হয়রান করেন। অসদাচরণ থেকে শুরু করে রুম থেকে বের করে দেন। এমন ধরণের শত শত অভিযোগ রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলা হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা পেয়ার মোহাম্মদ এর বিরুদ্ধে ।

গত বছর ১৩ জুন বাঘাইছড়ি উপজেলায় হিসাব রক্ষণ কার্যালয়ে দায়িত্ব নিয়ে যেন দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন নিজের অফিসকে। এর আগের কর্মস্থল কাপ্তাইয়েও এ ধরণের অভিযোগ রয়েছে।

ভুক্তভোগীরা জানান, পেয়ার মোহাম্মদ বাঘাইছড়ি উপজেলায় দায়িত্ব নেওয়ার পর তার কার্যালয়টি দুর্নীতির আখড়া বানিয়েছে।

নানা অজুহাতে পেনশন ভোগী কর্মকর্তা কর্মচারী, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা কর্মচারী, এসিল্যান্ড অফিস, মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সমাজ সেবা কার্যালয়, মৎস্য কর্মকর্তা, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা, উপজেলা প্রকৌশল বিভাগ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, প্রধানমন্ত্রীর দূর্যোগ সহনীয় ঘর তৈরি প্রকল্প সহ বিভিন্ন রাষ্ট্রিয় বাহিনীর সাথেও বিল পাসে ঘুষের পার্সেন্ট নিয়ে ঝামেলায় জড়িয়েছেন।

কথায় কথায় জেলা ও বিভাগীয় হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তাদের নাম ভাঙ্গিয়ে মোটা অংকের ঘুষ দাবী করেন। ১৫ মিনিটের এমন একটি ভিডিও পাহাড়ের খবর’এর কাছে সংরক্ষিত আছে।

ভিডিওটিতে দেখা যায়, উপজেলা হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা পেয়ার মোহাম্মদ তার বিভাগীয় কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে বাঘাইছড়ি উপজেলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নেতাদের বলছেন

“ওনাকে বিশ পার্সেন্ট দিতে হবে। বরিশালের লোক তো একটু লোভ বেশি, কিছুদিন পূর্বে আমার এখানে এসে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে গেছেন, তার বউয়ের জন্য শাড়ী, ছেলের জন্য স্কুল ব্যাগ কিনে দিয়েছি। টাকা নিয়ে আসেন তিন দিনের ভেতর বিল পাস করে দেবো। জুন মাসের আগে চাহিদা মত টাকা না দিলে বরাদ্দের টাকা ফেরত পাঠিয়ে দেবো তখন আগামী আগষ্টের আগে টাকা পাবেন না।”

এ ছাড়াও বাঘাইছড়ি উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মচারী মৃত তসলিম উদ্দিনের পেনশনের টাকা থেকেও ৩ লক্ষ টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।

মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নুর মোহাম্মদ বলেন,

আমাদের বৈধ পে-স্কেলে বেতন নির্ধারনের জন্য সে নানান হয়রানি করে আমার অফিসের তিনজন স্টাফের কাছে ৩০ হাজার আমার কাছ থেকে ১০ হাজার মোট ৪০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে নতুন পে-স্কেলে নিজ হাতে বেতন নির্ধারণ করে দেয়। একমাস বেতন ভাতা তোলার পর আবার বেতন বন্ধ করে রাখে।

বেতন বন্ধের কারণ জানতে চাইলে হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা পেয়ার মোহাম্মদ জানায় তার বিভাগীয় কর্মকর্তা আপাতত বন্ধ রাখতে বলেছেন। পর পর তিনমাস বেতন বন্ধ রাখার পর অনেক হয়রানি করে।

সিজিএ চিঠি মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়েছে আমরা অপেক্ষা করেছি। সব ঠিক হয়ে বেতনের চিঠি আসলে আবার নতুন করে হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দাবী করেন।

বেতন থেকে আর এক টাকাও ঘুষ দিতে পারবো না বলায় তিনি বলেন, আপনি একসাথে অনেক টাকা বকেয়া পাবেন। পেনশনে বেশি টাকা পাবেন। আচ্ছা এখন আপাতত ৮০ হাজার টাকা দেন। সামনে ঈদ তিন মাস বেতন বন্ধ তাই ১০ হাজার টাকা দিয়ে অনেক আকুতি করে বেতন উত্তলন করি।

একই মাসে আবার টাকার জন্য চাপ দেয়। আর কোন টাকা দিতে পারবো না বলায় সে দম্ভ করে বলে আপনার ৬ মাসের বেতন বন্ধ করে দিব। এই বলে আমাকে আবার পূর্বের পে-স্কেলে নামিয়ে দেয় এবং প্রতিনিয়ত আমার সাথে অসদাচরণ করে বেতন কমিয়ে হয়রানি করছে।

বিষয়টি আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম স্যারকে জানিয়ে প্রতিকার চেয়েছি এখনো পাইনি।

উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি (এসিল্যান্ড) মংশিনু মারমা বলেন আমার চাকুরী জীবনে এমন হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা দেখিনি তার ভাবখানা এমন যে তিনিই আমাদের বেতন দেন।

গত তিন মাস ধরে মিথ্যা বলে আমার এল,পি,সি আটকে রেখে আমাকে হয়রানি করছে। বেতনের টাকায় আমাদের সংসার চলে তিনমাস ধরে আমি বেতন তুলতে পারছি না আমার অফিস সহকারী তাজুল ইসলামের সাথেও সে খারাপ আচরণ করছে বিষয়টি আমার নির্বাহী কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম স্যারকে অভিযোগ আকারে জানিয়েছি।

উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা জয়াস চাকমা বলেন, হিসাব রক্ষণ কর্মকতা প্রতিটি বিলের জন্য পাঁচ থেকে দশ পার্সেন্ট হারে ঘুষ দাবী করেন চাহিদা মত টাকা না দিলে সব বিল বরাদ্দ আটকে রেখে হয়রানি করে। হিসাব কষে দশ টাকা সহ তাকে দিতে হয়। পেনসন ভাতা ভোগীদের কাছ থেকেও প্রতি মাসে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা কেটে রাখে।

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা নব আলো চাকমা বলেন, আমার ২৭ বছরের চাকুরী জীবনে এমন কর্মকর্তা দেখিনি। সব ধরনের বিল থেকে ৫-১০ পার্সেন্ট ঘুষ দিতে হয়, ঘুষ না দিলে ৬ মাস বেতন বন্ধ রাখার হুমকি দেন, আমরা অবিলম্বে তার অপসারণ চাই।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ জয়নাল আবেদীন বলেন, বড় প্রতিষ্ঠান হওয়ায় হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা পেয়ার মোহাম্মদ এর দ্বারা সবচেয়ে বেশি হয়রানি হতে হয় আমাকে ঘুষের টাকা ছাড়া ওনার সাথে কোন কথাই বলা যায়না।

আমার প্রাথমিক শিক্ষকদের সঙ্গে তিনি খুব খারাপ ব্যবহার করেন। শিক্ষকরা প্রায়ই আমাকে অভিযোগ দেন। ফাইল আটকে হয়রানি করে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নেতা সহকারী শিক্ষক মোঃ বাবুল মিঞা বলেন,

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি মাসেই তিনি হয়রানি করেন। উপজেলায় তিনশত পেনশনভোগী শিক্ষক আছেন। প্রতিমাসের তাদের কাছ থেকে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা কেটে রাখেন। জিপিএফ ফান্ড থেকে লোন নিতে তাকে প্রতি লাখে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা ঘুষ দিতে হয়। না হলে লোন অনুমোদন হয় না। সরকার শিক্ষকদের ১৩ম গ্রেড ঘোষণা করেছে। সেই গ্রেড লাগাতে শিক্ষকদের কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন।

ইওএনডিপি পরিচালিত ২২ টি বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেছে সরকার সেই বিদ্যালয়ের প্রতিজন শিক্ষক থেকে ৩ হাজার টাকা ঘুষ দাবী করেছেন।

৮৭ জন শিক্ষকের বকেয়া বেতন ভাতা ১২ কোটি ৮১ লক্ষ টাকা থেকে ২০ পার্সেন্ট হারে মোট আড়াই কোটি টাকা তিনি ঘুষ দাবী করেন। সেই টাকা থেকে ৭০ পার্সেন্ট জেলা ও বিভাগীয় অফিসে দিতে হবে বলেন। এতদিন যেই শিক্ষকরা না খেয়ে পাঠদান চালিয়ে গেছেন তাদের টাকা থেকে কিভাবে এতো টাকা তিনি ঘুষ দাবী করেন এটা নিয়ে ওনার সাথে শিক্ষকদের কথা-কাটাকাটি হয়েছে সেই ভিডিও আমাদের হাতে রয়েছে।

উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন মামুন বলেন সব ধরনের বিলের আগে ওনাকে এক পার্সেন্ট পিসি দিতে হয়। না হলে বিল পাস হয়না।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে চরম হয়রানী করেন। তার বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যাবস্থা নেয়ার জোর দাবী জানাচ্ছি। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।

বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা বলেন,

বাঘাইছড়ি উপজেলায় হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তাই নয় এমন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা আরো আছে। উপজেলা পরিষদ আইনের দূর্বলতার কারণে এসব অসাধু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নিতে পারছি না। তবে শিগগির এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বাঘাইছড়ির সচেতন মহল জেগে উঠবে।

এ বিষয়ে বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বলেন,

তার বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত অভিযোগ পাচ্ছি, আমি নিজেও ভুক্তভোগী, সে ঠিকমত অফিস করেন না, মানুষ কে হয়রানি করে লিখিত অভিযোগ পেলে উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এসব অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা পেয়ার মোহাম্মদের এ ব্যাপারে সংবাদ প্রচার না করতে অনুরোধ করেন। বলেন, বাঘাইছড়ি কি ভালো জায়গা নাকি? এখানে থাকার আর ইচ্ছে নাই। এক মাসের মধ্য বদলি হয়ে যাব।

মন্তব্য বন্ধ আছে তবে ট্র্যাকব্যাক ও পিংব্যাক চালু রয়েছে।