স্বপ্নহারা এক শিশুর পাশে ‘ভয়েস অব লংগদু’ — মানবতার গল্পে লেখা এক নতুন ভোর।

0 ১৬১

ডেক্স রিপোর্টঃ

প্রতিটি স্বপ্নের নিজস্ব ভাষা আছে। কারো চোখে তা ঝলমল করে ওঠে, আবার কারো চোখে চাপা কান্নার মতো জমে থাকে। শামীম তেমনই একটি শিশু—যার বয়স মাত্র নয় বছর। জন্মলগ্ন থেকেই জীবন তাকে শিখিয়েছে, শুধু শ্বাস নিলেই বাঁচা যায় না; প্রয়োজন হয় কারো ভালোবাসা, কারো হাত ধরে এগিয়ে যাওয়ার সাহস।

তিন বছর বয়সে বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ তার ছোট্ট জীবনে এক নীরব ঝড় নিয়ে আসে। ভালোবাসার উষ্ণ ছোঁয়া কিংবা পাশে থাকার প্রতিজ্ঞা—কোনোটাই তার ভাগ্যে জোটেনি। কুঁড়েঘরের পুরনো, ভাঁজ পড়া দেয়ালের ফাঁকেই কেটেছে তার শৈশব। পিতৃ-মাতৃস্নহীন শিশু শামীম বৃদ্ধ নানার আশ্রয়ে বেড়ে উঠছে, নানার চোখে স্বপ্ন ছিল—”নাতি একদিন আলোকিত মানুষ হবে, মানুষকে ভালোবাসবে, মানুষের জন্য বাঁচবে।”

বৃদ্ধ নানার সপ্ন পূরণের লক্ষ নিয়েই লংগদু উপজেলার আটারকছড়া ইউপির স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় শামীমের শিক্ষাজীবন শুরু হয়। মেধা ও একাগ্রতা ছিল তার সম্বল; তবে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী—যা বারবার তার স্বপ্নের পথে কাঁটা বিছিয়েছে। ২০২৪ সালে সে যখন স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা শেষের দোরগোড়ায়, দারিদ্র্যতা তখন তার স্বপ্নপূরণের দরজায় কঠিন এক ধাক্কা দেয়। ঠিক তখনই একঝাঁক ভালোবাসার মানুষ হয়ে ‘ভয়েস অব লংগদু’ ছুটে আসে তার পাশে। এই স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক অনলাইন কমিউনিটির সহায়তায় শামীম ভর্তি হয় চট্টগ্রামের হাটহাজারীর একটি স্বনামধন্য কওমি মাদ্রাসায়।

সেখানে শামীম আবারও প্রমাণ করে—প্রতিভার কোনো বয়স হয় না, অভাব তাকে আটকে রাখতে পারে না। ‘ইয়াজ দাহুম’ (৫ম শ্রেণি সমমান) সাফল্যের সাথে পেরিয়ে সে এখন ‘জামাতে দাহুম’ (৬ষ্ঠ শ্রেণি সমমান)-এর জন্য প্রস্তুত। কিন্তু দারিদ্র্যতা তাকে সহজে পিছু ছাড়ে না। বৃদ্ধ নানার পক্ষে এবারও তার খরচ বহন করা সম্ভব হচ্ছিল না, তাই আবারও থমকে যায় শামীমের পড়াশুনা। তবে এবারও নীরব থাকেনি ‘ভয়েস অব লংগদু’। শিশু শামীমের জন্য এককালীন আর্থিক সহায়তা পৌঁছে যায় তার নানার হাতে, সেই সঙ্গে পৌঁছে যায় ভালোবাসার উষ্ণতায় মোড়া নতুন এক প্রেরণা। শুধু এককালীন সাহায্য নয়, শামীম যেন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয়—সে বিষয়টিও নিশ্চিত করছে এই সংগঠন। প্রতি বছর প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা এবং প্রতি তিন মাসে একবার ‘সম্পাদক বৃত্তি’ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ‘ভয়েস অব লংগদু’।

সংগঠনের আহ্বায়ক মোঃ তারিকুল ইসলাম তারা বলেন, “শামীমের মতো শিশুরা যদি হার না মানে, তাহলে কোনো স্বপ্নই হারিয়ে যাবে না। ভয়েস অব লংগদু সেই স্বপ্নগুলো বাঁচিয়ে রাখতেই কাজ করে যাচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি—মানুষ মানুষের জন্য। তাই আমরা ছিলাম, আছি এবং ভবিষ্যতেও থাকব ইনশাআল্লাহ।”

২০১৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মানবিক সহায়তা, রক্তদান, জনসচেতনতা এবং আর্তপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার নিয়ে গড়ে ওঠা ভয়েস অব লংগদু আজ শুধুই একটি সংগঠন নয়— এটি লংগদুর মানুষের মানবিক আশ্রয়স্থল। এই সংগঠন প্রথমবারের মতো উপজেলায় অনলাইন ব্লাড ব্যাংক চালু করে, যা আজ হাজারো মানুষকে জীবন বাঁচাতে সহায়তা করছে। সুদীর্ঘ নয় বছরে ভয়েস অব লংগদু অসংখ্য মুমূর্ষু রোগীকে রক্তদান, দুরারোগ্য রোগের আক্রান্তদের চিকিৎসা সহায়তা, গৃহহীনদের ঘর নির্মাণ, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় সহায়তা, এবং প্রতিবন্ধী বেকারদের স্বাবলম্বী করে তোলার মতো ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। লংগদু উপজেলা জুড়ে সংগঠনটি এক আলোকবর্তিকার মতো কাজ করে যাচ্ছে। তাদের অনুপ্রেরণায় গড়ে উঠেছে বহু নতুন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন যারা দিনরাত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মানবতার শিখা জ্বালিয়ে রাখছে।

ভয়েস অব লংগদু প্রমাণ করেছে— সহমর্মিতা, ভালোবাসা আর সেবার হাতই পারে একটি সমাজকে বদলে দিতে। শামীমদের মুখে হাসি ফোটানোই এর জীবন্ত প্রমাণ।

আপনার ইমেইল প্রদর্শন করা হবে না।