জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক অস্পষ্ট ঘোষণাপত্র এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

0 ৫১২

ডেস্ক রিপোর্টঃ

ইতিহাস নতুন সংস্করণ বা রুপান্তর অসম্ভব সত্ত্বেও, কিছু চতুর ইতিহাস বিকৃত করার নিমিত্তে দুই শতক পূর্ব থেকে পার্বত্য চট্রগ্রামে বসবাসরত অবাঙ্গালীদের পরিচয় বদলানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত।

যারা অতি সম্প্রতি নিজেদের উপজাতি বা পাহাড়ি বলে পরিচয় দিতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করতো। তারা হঠাৎ করেই নিজেদেরকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে প্রমাণ করতে, উঠে পরে লাগার কারণটা হয়তো অনেকেরই অজানা।

মূলত ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে, ‘আদিবাসীদের অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের ঘোষণা পত্র ২০০৭’ গৃহীত হওয়ার পর থেকেই পার্বত্যাঞ্চলের নেতৃবৃন্দ এবং দেশের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি এই বিষয় নিয়ে অস্বাভাবিক রকমের সরব হয়ে উঠেন।

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা যেসব আন্তর্জাতিক দলিলের অজুহাত দেখিয়ে নিজেদের আদিবাসী দাবি তোলেন সেগুলোর মধ্যে জাতিসংঘের আদিবাসী অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্র ২০০৭ অন্যতম।

চলুন, দেখে আসি…… জাতিসংঘের আদিবাসী অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্র কি বলে!!!

ঘোষণাপত্রটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর যেসব অধিকার নিশ্চিত করেছে, তার মধ্যে রয়েছে- ভূমি অধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, স্বায়ত্তশাসনের অধিকার, জাতীয়তা লাভের অধিকার ও জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ। জাতিসংঘের এই ঘোষণাপত্রে যে বিষয়গুলোই আদিবাসীদের অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তা একটি অঞ্চল বা দেশ বিভাজনের জন্য যথেষ্ট। যার জন্য ঘোষণাপত্রটি পুরো বিশ্বজুড়ে বেশ সমালোচিতও হয়েছে। জাতিসংঘের এই ঘোষণাপত্রের পক্ষে ১৪৪ টি দেশ, বিপক্ষে ৪ টি দেশ (অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) এবং ১১ টি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল। ভোট দানে বিরত থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।

বিস্ময়কর হলেও সত্য, জাতিসংঘ আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরাম আদিবাসীর সংজ্ঞা স্পষ্ট না করেই, আদিবাসীদের অধিকার সংক্রান্ত এই গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করেছে। এতে যে কোনো সংখ্যালঘু গোষ্ঠি নিজেদের আদিবাসী বা উপজাতি ঘোষণা করার সুযোগ থেকে যায়। তাই বাংলাদেশকে ঘায়েল করতে সুযোগসন্ধানী উপজাতিরাও সেই কৌশল অবলম্বনে বিন্দুমাত্র ভুল করেনি। তারা জাতিসংঘ প্রদত্ত আদিবাসীদের ঘোষণাপত্রের বাড়তি অধিকার প্রাপ্য হতে, নিজেদের আদিবাসীতে রুপান্তর এবং সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে কোমর বেধে নেমে পড়ে।

তবে, জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রের আদিবাসী সংক্রান্ত অস্পষ্ট বিষয়টি আইএলও কনভেনশন ১৬৯ এর দিকে আলোকপাত করলে স্পষ্ট হওয়া যায়। আইএলও কনভেনশন ১৬৯ এর প্রথম খণ্ডে উপজাতি এবং আদিবাসীদের আলাদা সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে। কনভেনশনের প্রথম খণ্ডের ধারা ১ এর ‘খ’ তে বলা হয়েছে- আদিবাসী তারা যারা একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রে বংশানুক্রমে বসবাস করছে বা অধিকৃত হওয়া ও উপনিবেশ সৃষ্টির পূর্ব থেকে বসবাস করছে এবং যারা তাদের সকল নিজস্ব সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, আইনগত অধিকার ও প্রতিষ্ঠানসমূহ ধরে রাখে। এখানে স্পষ্ট বুঝা যায়, আইএলও’র এই সংজ্ঞাটি বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সাথে কোনো অংশে মিল নেই। তাহলে কি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার লোকজন আদিবাসী নয়??

এ বিষয়ে ইতিহাস কি বলছে দেখে আসি….
ইতিহাস বলছে, বাংলাদেশে বসবাসরত উপজাতিরা কোনোভাবে এই ভৌগোলিক অঞ্চলের বংশধর নয়। তাদের পূর্বপুরুষদের বসবাস ছিলো- বার্মার চম্পকনগর, মঙ্গোলীয় ও ভারতের তিব্বত, ত্রিপুরা এবং মিজোরামে। এমনকি প্রথম উপনিবেশ সময়েও উপজাতিদের বসবাস বাংলাদেশে ছিলোনা। তারা পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন দেশ থেকে যুদ্ধে বিতাড়িত হয়ে এ দেশে ব্রিটিশ আমলে আগমন করেছে। (সূত্রঃ কার্পাস মহল থেকে শান্তি চুক্তি-আনন্দ বিকাশ চাকমা, বমাং রাজার সংলাপ)

তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি (হিল ম্যানুয়েল ১৯০০) ব্রিটিশ কর্তৃক প্রণীত। উপজাতিদের সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবকাঠামো বলতে কিছুই নেই। তারা ব্রিটিশদের চাপিয়ে দেয়া সামাজিক বিধান মেনে চলছে। এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের কোন রাজনীতি করার ইতিহাসও পাওয়া যায়নি। বর্তমানে তাদের যে রাজনৈতিক দলগুলোর কথা বলা হচ্ছে, সত্যিকার অর্থে সেগুলো হলো- মিসগাইড হওয়া কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ।

এখানে প্রশ্ন থেকে যায়…… আইএলও কনভেনশন ১৬৯ এর আদিবাসী সংজ্ঞার সাথে মিল না থাকা ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীরা, তাহলে কি হিসেবে চিহ্নিত হবে…?

এ বিষয়ে জানতে আমাদের যেতে হবে আইএলও কনভেনশন ১৬৯ এর প্রথম খণ্ডের ধারা ১ এর ‘ক’ তে।
সেখানে বলা হয়েছে- একটি দেশের মূল জনগোষ্ঠী থেকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্নতর, যারা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও আইন দ্বারা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পরিচালিত তাদেরকে উপজাতি বলা হয়। আইএলও’র এই সংজ্ঞাটি যদি আমরা বাংলাদেশের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তুলনা করি তাহলে পরিষ্কার বোঝা যায় এরা উপজাতি।

আইএলও কনভেনশন ১৬৯ প্রথম খণ্ডের অনুচ্ছেদ ১ এর ‘ক’ ও ‘খ’ ধারা বিশ্লেষণ এবং ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে, বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীরা কোনোক্রমেই এ দেশের আদিবাসী নয়।
সুতরাং জাতিসংঘ ঘোষিত আদিবাসী সংক্রান্ত কোনো আন্তর্জাতিক দলিল বা অধিকার উপজাতি জনগোষ্ঠীর জন্য প্রযোজ্য নয়।

অথচ, বাংলাদেশের উপজাতিরা এই কনভেনশনের যেই ধারাটি তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সেটি এড়িয়ে যায় এবং যেই ধারাটি তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় সেটি আমলে নিয়ে বারংবার আদিবাসী তকমা লাগানোর পায়তারা চালায়।

এই অবাঙ্গালীদের পরিচয় বদলানোর অপচেষ্টা এখানেই শেষ নয়…
এদেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, সুশীল, মানবাধিকার কর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষকগণ ও গণমাধ্যমগুলো আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রের ভুলব্যাখা দিয়ে উপজাতিদের আদিবাসী বানাতে অপতৎপরতা চালাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ- তারা অধিকাংশই বিদেশী এনজিও, দাতাসংস্থা, খ্রিষ্টান মিশনারী ও পশ্চিমা অপশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত। এসব পশ্চিমা মদদপুষ্ট হলুদ গণমাধ্যম ও তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের আদিবাসী বিষয় নিয়ে পরিকল্পিত টকশো, উস্কানিমূলক এবং পক্ষপাতদুষ্ট লেখালেখির মাধ্যমে উপজাতিদের আদিবাসী হিসেবে প্রচার করায়, দেশের অধিকাংশ মানুষ লাভ ক্ষতি বিবেচনা না করেই উপজাতিদের আদিবাসী হিসেবে সম্বোধন করছে।

অথচ, বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৩ এর (ক) ধারায় এসব জাতিসত্তাকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, উপজাতি বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তা হিসেবে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় সংবিধান অকার্যকর করে আদিবাসী দাবি করা এবং আদিবাসী প্রচারে সহায়তা করা, উভয়ই সংবিধান লঙ্ঘনের ধৃষ্টতা দেখানোর শামিল নয় কি??

তবে, এর আগে ১৯ জুলাই ২০২২ সালে ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহার বন্ধে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। কিন্তু, সেই নিষেধাজ্ঞা তোয়াক্কা না করে দিব্যি আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার চলছে সর্বস্তরেই। বাস্তবিক অর্থে, শুধু দায়সারা ভাবে প্রজ্ঞাপন জারি করে আদিবাসী শব্দ ব্যবহার বন্ধ করা আদৌ সম্ভব নয়। তাই সংবিধান বিরোধীদের চক্রান্ত কুক্ষিগত করতে রাষ্ট্রীয় কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ অতীব জরুরী।

লেখক: মামুন ভূইয়া
থানচি, বান্দরবান

আপনার ইমেইল প্রদর্শন করা হবে না।